বিএনএ, বিশেষ প্রতিনিধি ( আনোয়ারা থেকে ফিরে): আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল আহমদ ২০২৩ সালে ২৩ জুন যোগদান করেন। এর আগে তিনি কুয়াকাটা মহিপুর, মৌলবীবাজার থানায় দায়িত্ব পালন করেন। যোগদানের পর ওসি সোহেল আহমেদ ঘোষণা করেছিলেন আনোয়ারায় মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স । এলাকায় কোন মাদক ও অনৈতিক কাজ চলবে না। পুলিশের পেশাদারিত্ব বজায় রেখে জনগণকে সেবা দিবেন।
ওসি সোহেলের এমন কথায় আনোয়ারার সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যম কর্মীরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। রেখে ছিলেন পূর্ণাঙ্গ আস্থা । কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা গেল এসব ছিল ওসির কথার ফুলঝুরি। কার্যক্ষেত্রে তিনি উল্টোটায় করেন। মাদক ব্যবসায়িদের থেকে মাসোহারা, সাধারণ মানুষকে থানায় ধরে এনে টাকা আদায়, মিমাংসার নামে নিরীহ মানুষকে বিএনপি জামায়াতের তকমা দিয়ে হয়রানি, বিচারপ্রার্থীর মামলা না নিয়ে আসামিদের থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পাল্টা মামলা দায়ের করা ওসি সোহেল আহমেদের যেন রুটিন ওয়ার্ক। তার সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রম করলে নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। এক কথায় সাধারণ মানুষের কাছে মুর্তিমান আতঙ্কের নাম আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহমেদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৯ এপ্রিল বিকালে আনোয়ারা থানার ঝিওরী গ্রামে দুই ভাইয়ের ঝগড়া থামাতে গিয়েছিল মৃত ছিদ্দিক আহমেদের পুত্র ৬০ বছর বয়সি বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ। কিন্তু ঝগড়ায় লিপ্ত, হাসান শরীফ (৪০), আবু সৈয়দ (৫০) জামির হোসেন (২৫), আশরাফ উদ্দিন, আব্দুর নুর (৩৫) তাকে বেদম মারধর করে। এক পর্যায়ে ইট দিয়ে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন। পিতা ইদ্রিচের আর্তচিৎকারে পুত্র মুন্না (২৪) এগিয়ে এলে তাকে মারধর করা হয়। এই অবস্থায় বৃদ্ধ ইদ্রিচ আনোয়ারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নেয়। পরে মামলা করতে আনোয়ারা থানায় যান এবং ওসির সঙ্গে দেখা করেন। রক্তাক্ত ইদ্রিচকে দেখে ওসি সোহেল খুব সমবেদনা জানান। ঠান্ডা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করান। তাৎক্ষনিকভাবে একজন এসআইকে ডেকে একটি অভিযোগ নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসামিদের গ্রেপ্তারের নিদের্শ দেয়। এতে খুশি হয়ে বৃদ্ধ ইদ্রিচ বাড়িতে চলে যান।কিন্তু মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে গনেশ উল্টে যায়।
পুলিশ আসামিদের বাড়িতে এসে খোশগল্প করেন এবং তাদের থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরার্মশ দেন। রাতেই আসামিরা মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে সমর্থ হন। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আসামীরা হামলার শিকার বৃদ্ধ ইদ্রিচের বাড়িতে ফের চড়াও হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে বৃদ্ধ ইদ্রিচ ও তার পুত্র মুন্না থানায় উপস্থিত হয়ে ওসি সোহেল আহমেদের কাছে আসামীদের বিষয়ে প্রতিকার চান। ইদ্রিচ তার দেয়া মামলাটি লিপিবদ্ধ এবং আসামীদের গ্রেফতারে অনুনয়-বিননয় করেন। কিন্তু ওসি সোহেল আহমেদ ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যান এবং অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করেন। তার নিরাপত্তার বিষয়টি জানালে ওসি সোহেল কিছুদিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে থাকার কথা বলে তার কক্ষ থেকে বের করে দেন।
এই অবস্থায় রাতে শহরে এসে তিনি এক আত্মীয়ের বাসায় এসে আশ্রয় নেন। হামলার শিকার বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ পরদিন ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হারুন মামলাটি আমলে নেন এবং আনোয়ারা থানার ওসিকে মামলাটি রের্কড করে তার অনুলিপি ১৫ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ১২ এপ্রিল আদেশের কপি পেয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন ওসি সোহেল আহমেদ। একজন এসআইকে ডেকে বলেন, ‘শালা আদালতে গেল কেন? বদমাইশ বুড়ারে ধরে নিয়ে আয়’ আর আসামিদের খবর দে, তারা যেন এসে একটা মামলা দিয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ৮ এপ্রিল বিকালের ঘটনায় ৯ এপ্রিল সকালে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ করতে অন্ধ মেন্না মিয়ার দুই কন্যা তসলিমা আক্তার (২৫) ও ইসমো আক্তার (২৩) আনোয়ারা থানায় মামলা করতে যায়। কিন্তু ওসি মামলা নেয়নি। পরে ১০ এপ্রিল তসলিমা আক্তার বাদী হয়ে চট্টগ্রাম চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করে। আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্য ওসি আনোয়ারাকে নির্দেশ দেয়। মামলার কপি পেয়ে আরেক দফা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ওসি সোহেল। ফন্দি করে দুই মামলার বাদি এবং স্বাক্ষীদের শায়েস্তা করার। খবর দিয়ে মামলার আসামিদের থানায় ডেকে আনেন। পরার্মশ দেন পাল্টা মামলা না করলে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠাবেন। এই অবস্থায় আসামী মনোয়ারা বেগম (৪৫)কে দিয়ে আদালতে মামলা দায়েরকারি বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ, তার দুই ছেলে এবং অপর মামলা দায়েরকারি তসলিমা আক্তার, তার ছোট এক ভাই ও এক বোনকে আসামী করে একই ধারায় গত ১৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০ টায় পাল্টা মামলা রের্কড করেন।
জামিন অযোগ্য ধারায় দায়ের করা মামলাটি রের্কড হওয়ার পরপর রাতেই বাদি ইদ্রিচ ও তসলিমাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ পাঠায় ওসি। কিন্তু পাল্টা মামলার বাদী মনোয়ারা বেগম বাড়িতে এসে প্রতিবেশীদের ওসির কথা মতো বৃদ্ধ ইদ্রিচ ও তসলিমাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ফাঁস করে দেয়। একই সঙ্গে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার কথাও জানায় মনোয়ারা বেগম। পাল্টা মামলার আসামী ইদ্রিচসহ অন্যরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
প্রশ্ন হলো শুধু কী এই প্রথম ওসি সোহেল আহমেদ এমন অনৈতিক কাজ করেছেন? তা কিন্তু নয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৩ সালে ২৩ জুন ওসি হিসাবে যোগদানের পর থেকে তিনি এই ধরনের অপেশাদার কাজে যুক্ত রয়েছেন। টাকা নিয়ে মামলা করাকে তিনি তার কথিত পেশাদার কাজ মনে করেন।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কটের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অবরোধের ডাক দেয়। আনোয়ারা চাতুরি এলাকায় শশী কমিউনিটি সেন্টারের সামনে পুলিশের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এই খবর পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ক্লারিক্যাল সুপারভাইজার ও শশী কমিউনিটি সেন্টারের মালিক নাছির উদ্দিন জানতে পারে। তার সঙ্গে বিরোধ রয়েছে চাতুরি চৌমুহনী এলাকার বাসিন্দা পদ্মা অয়েল কোম্পানির ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মোহাম্মদ হারুন চৌধুরীর। নাছির উদ্দিন যখন থানায় উপস্থিত হন তার আগেই এসআই জয়নাল আবেদীন বাদি হয়ে নাশকতার অভিযোগে বিএনপি ১৬জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। যা বিকাল ৪টা ৫ মিনিটে অনলাইনেই লিপিবদ্ধ করা হয়।
নাছির থানায় বিলম্বে উপস্থিত হওয়ায় পুলিশের দায়ের করা ওই মামলায় পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত তার প্রতিদ্বন্দ্বী ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাতে কী? টাকায় কী না হয় ?
আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহমেদ পুলিশের দায়ের করা ১৬ আসামি এবং নাছিরের প্রতিপক্ষ ৫ জনসহ ২১ জনকে আসামী করে নতুন আরও একটি মামলা রের্কড করে নাশকতার ধারায়। মামলার বাদি করা হয় নাছির উদ্দিনের মালিকানাধীন শশী কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজার রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরীকে। এই মামলায় ১১ নম্বর আসামি করা হয় আনোয়ারা থানার চৌমুহনীর উত্তর চাতরী গ্রামের প্রয়াত গোলাম কাদেরের সন্তান পদ্মা অয়েল কোম্পানির ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে। যা অনলাইনে পোস্টিং হয় রাত সাড়ে আটটায়।
মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এজাহারে বাদি রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরী যোগাযোগের জন্য যে নম্বরটি উল্লেখ করেছে তা শশী কমিউনিটি সেন্টারে সাইনবোর্ডেও উল্লেখ রয়েছে। শোভা পাচ্ছে! অথচ শশী কমিউনিটি সেন্টারে হামলা ভাঙচুর বা হামলার কথা উল্লেখ নেই মামলায়। একই ঘটনায় একই স্থানে একই সময়ে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করার পর নাছির উদ্দিনের মালিকানাধীন শশী কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজার রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরীকে দিয়ে কেন পৃথক একটি নাশকতার মামলা দিলেন আনোয়ারা থানার ওসি?
কেনইবা আসামীর তালিকায় পদ্মা অয়েল কোম্পানির ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে বিএনপির কর্মী বানিয়ে ১১ নম্বর আসামী করা হলো? ঘটনার দিন হারুন চৌধুরী কর্মস্থলে ছিলেন। পরে তাকে কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে আনোয়ারা থানা পুলিশ। কিন্তু কেইপিজেড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মামলার ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এই মামলায় প্রায় দুই মাসের বেশি চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন পদ্মার কর্মচারি মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী। এইভাবে প্রতিপক্ষ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করেন ওসি সোহেল আহমেদ। অথচ নাশকতার মামলার আসামীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অভিযোগ আছে, ইয়াবা চোরাচালানের অন্যতম রুট আনোয়ারা। টেকনাফ থেকে সরাসরি ইয়াবা ট্রানজিট হয় এখানে। কিন্তু বর্তমান ওসি থানায় যোগদানের পর থেকে ইয়াবা উদ্ধার অভিযানে ভাটা পড়েছে। তার অন্যতম কারণ ইয়াবা ব্যবসায়িদের থেকে মাসে মাসে টাকা নিয়ে থাকেন। ফলে গহিরা ও রায়পুর এখন মাদক পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে।
আনোয়ারা থানার বর্তমান ওসি সোহেল আহমেদ দম্ভোক্তি করে বলেন, ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় এমপিকে তিনি মেন্টেইন করেন। যতদিন তাদের ছায়া থাকবে ততদিন, যত অন্যায়, অপরাধ করলে তার কিছুই হবে না। অভিযোগ আছে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করা ওসি সোহেলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বিএনএনিউজ২৪ডটকম/এইচমুন্নী /হাসনা