বিএনএ ডেস্ক : সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ তার যুক্তরাজ্যে হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন। এই সঙ্গে সরকারকেও তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন। যে কোন সময় তিনি দূর্নীতি দমন কমিশনের মুখোমুখি হতে পারেন। ইতোমধ্যে দুদক তার সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করেছে। এইসব সম্পদের বৈধ দলিলাদি দেখাতে ব্যর্থ হলে ফেঁসে যেতে পারেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। যুক্তরাজ্যে তার বিশাল সম্পদের পাহাড় নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ। খবরটি যুক্তরাষ্ট্রেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
২০ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অবগত। নির্বাচিত সব কর্মকর্তা যাতে দেশের আইন ও আর্থিক বিধিবিধান মেনে চলেন, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানান মিষ্টার মিলার।
প্রসঙ্গত, ব্লুমবার্গের ১৮ ফেব্রুয়ারির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন যুক্তরাজ্যে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন; যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের প্রায় আড়াইশ সম্পত্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্লুমবার্গ বলছে, যখন এসব সম্পত্তি কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি অর্থাৎ নতুন বাড়ি।
দুর্নীতি বিরোধীরা বলছেন, রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা আছে এমন লেনদেন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আইন আদৌ কার্যকর কি না, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এসব সম্পত্তির কারণে সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
এ দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনেও সাইফুজ্জামানের অন্তত পাঁচটি সম্পত্তি খুঁজে পেয়েছে ব্লুমবার্গ। মিউনিসিপ্যাল প্রপার্টি রেকর্ডসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, প্রায় ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনী ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন টাকা অর্থাৎ দুই দশমিক চার মিলিয়ন ডলার এবং তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তার যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি। মন্ত্রী হিসেবে ২০২২-২০২৩ সালে তার বেতন প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড হিসাবে দেখানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ব্লুমবার্গকে বলেন, বাংলাদেশে বসবাসরত অবস্থায় একজন ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ অর্জনের কোনো বিধান নেই। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, আমরা ব্যক্তিদের এ ধরনের কিছু করার অনুমতি দেই না।
বাংলাদেশের বাহিরে নিজের সম্পত্তির মালিকানা প্রসঙ্গে ব্লুমবার্গের পক্ষ থেকে মন্তব্য চেয়ে অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেননি সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
যুক্তরাজ্যের ২০১৭ সালের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং আইনে সংজ্ঞায়িত ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসন (পিইপি)’ ক্যাটাগরিতে পড়েন সাইফুজ্জামান। এটি যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সম্পত্তির এজেন্ট, ঋণদাতা, প্রপার্টি আইনজীবী এবং অন্যদের ওপর পিইপি শনাক্ত করার কাজ করে। যদিও এসব ব্যক্তি সম্পত্তি কেনার মতো ব্যবসায়িক লেনদেনে নিযুক্ত থাকলে তাদের সম্পৃক্ততা অতিরিক্ত তদন্তের দাবি রাখে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য সম্পত্তি কেনার সঙ্গে জড়িত আর্থিক সেবা ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ব্লুমবার্গ। এর মধ্যে উত্তর দিতে রাজি হওয়া সংস্থাগুলোর দাবি, লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে ‘বাণিজ্যিক গোপনীয়তার’ কারণে বিস্তারিত কিছু জানায়নি তারা।
২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২০৩ বিলিয়ন টাকার ব্যবসার বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে আনে। যদিও টিআইবি ওই সময় কোনো মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি, তবে তারা বলেছে, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য চায়, তাহলে তারা এর প্রমাণ দিতে প্রস্তুত। এর মধ্যেই দেশে সংবাদ মাধ্যম সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাম প্রকাশ করে দেয় এবং সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার বাবা, প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে পা রাখেন। এর এক বছর পর ২০১৪ সালে ভূমি প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর নির্মাণ কোম্পানি আরামিট পিএলসি এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি-র বড় পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
ওই সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খালি হাতে এসেছি এবং আমি খালি হাতে যাব’। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণ অনুসারে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার কিছু আত্মীয় সরাসরি বা সহায়ক সংস্থার মাধ্যমে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির ব্যক্তিগত শেয়ারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা নিয়ন্ত্রণকারী অংশীদারিত্বের মালিক। এই পোর্টফোলিওতে চারটি পাবলিক কোম্পানি রয়েছে, তাদের মধ্যে আরামিট এবং ইউসিবির সম্মিলিত বাজার মূলধন প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী ইউসিবি’র চেয়ারম্যান, যেটি ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ পরিচালনা করে। আরামিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও রুখমিলা জামান।
বিদেশে বিপুল সম্পদ নিয়ে দেশী ও বিদেশী সংবাদ মাধ্যম অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ তার সম্পদের উৎস নির্বাচনী হলফনামায় যুক্ত না করার বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি। ফলে দিনের পর দিন বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সরকারও পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম সংসদীয় আসন ১৩ (আনোয়ারা) থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। মন্ত্রিসভায় পদ হারালেও, ভূমি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদে বহাল আছেন তিনি।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী