।। এনামুল হক নাবিদ ।।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের মূল প্রবেশ পথ ও গুরুত্বপূর্ণ থানা আনোয়ারা। জুলাই বিপ্লবে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর সারাদেশের মত আনোয়ারায়ও ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এর পর অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা উন্নতিতে অল্প সময়ে ঘুরে দাড়িয়েছে আনোয়ারা থানা পুলিশের কার্যক্রম। সরকার পতনের পর আনোয়ারায় বড় ধরনের কোন ঘটনা না ঘটলেও উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে থমকে যায় পুলিশি কার্যক্রম। একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম।
দেখা গেছে, এসময়ে পাশ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে একাধিক অপহরণ ও খুনের মত ঘটনা ঘটেই চলছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। সে অনুযায়ী জায়গা জমির দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আনোয়ারায় আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয় উল্লেখযোগ্য এমন ঘটনা ঘটেনি। এরই পেক্ষিতে ১০ আগস্ট থেকে আনোয়ারা থানার নিরাপত্তায় থাকেন সেনাবাহিনী। যার ফলপ্রসূত আনোয়ারা থানায় নিরাপত্তার ঘাটতি কমতে থাকে। পরে থানায় পুলিশরা দায়িত্বে ফিরলে থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। দেখা গেছে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশি কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলেও বন্ধ হয়নি চুরি-ছিনতাইয়ের মত ঘটনা।
এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থানার কাজ শুরু হলেও থানা পুলিশকে গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সারাদেশের মত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে আনোয়ারা থানা পুলিশের মধ্যে বদলি প্রক্রিয়া চলমান হয়। সে অনুযায়ী গত ১৩ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা থানায় নতুন ওসি হিসেবে মনির হোসেনকে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সংযুক্তি করা হয়। তিনি যোগদানের পর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা পুলিশি কার্যক্রম নতুনভাব ঢেলে সাজান। ওসি হিসেবে যোগদানের পর আইনশৃঙ্খলা উন্নতিতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। এর মধ্যে তিনি ভেঙে পড়া কমিউনিটি পুলিশিংকে গুরুত্ব দেন। যার ফলে আনোয়ারায় আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন মহল। যা গত তিন মাসের আনোয়ারা থানা পুলিশের অপরাধ বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় লক্ষ্য করার মত অভিযানের তথ্য পাওয়া যায়।
জুলাই আন্দোলনের সময় আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোল্লা জাকির হোসেন। তিনি ১০ জুলাই আনোয়ারা থানায় যোগদান করেছিলেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনের পর তাকে বদলি করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর নতুন ওসি হিসেবে যোগদান করেন মনির হোসেন।
থানা সূত্রে জানা যায়, গত তিন মাসে আনোয়ারা থানায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৩ জন। চোর, ডাকাত ও বিভিন্ন অপরাধী গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৭জন। তার মধ্যে অস্ত্রধারী ২জন, সিএনজি চোর ১১জন, ছিনতাইকারী ৭জন, কিশোর গ্যাং ৩০জন, মাদক ব্যবসায়ী ৩৭জন, অপহরণকারী ৭জন, সব চেয়ে বেশি গ্রেপ্তার করা হয়েছে গরু চোর। গরু চোর রয়েছে ৩৯জন। এর মধ্যে মাদক মামলা হয়েছে ২৭টি। উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে রয়েছে ২১হাজার ১০৭পিস ইয়াবা, ৩৭৫৫ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়েছে। কার্তুজসহ দুইটি এক নলা দেশীয় অস্ত্র। এছাড়াও শতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
একটি থানার জন্য কমিউনিটি পুলিশিং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা নাগরিকদের মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে থাকে। লোকবল সংকটের কারণেই কমিউনিটি পুলিশের ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আনুপাতিক হিসেবে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, গড়ে ৮১২ নাগরিকের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন একজন মাত্র পুলিশ সদস্য। অথচ ভারতে এবং উন্নত বিশ্বে পুলিশ সদস্যের এই আনুপাতিক হার চার থেকে পাঁচগুণেরও বেশি। আনোয়ারা থানা ইতিমধ্যে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম পুরোদমে কাজ শুরু করতে নাগরিকদের একটি তালিকা তৈরি সম্পন্ন হয়েছে।
থানা পুলিশের কমিউনিটি পুলিশের সূত্র বলছে, আনোয়ারায় কমিউনিটি পুলিশিং এর সাথে সম্পৃক্ত করতে প্রায় ১৩শ নাগরিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫১ বা ৬১ জনের একটি থানাভিত্তিক কমিটি গঠন করা হবে। এর পর প্রতিটি ইউনিয়ন ও ইউনিয়নের ওয়ার্ডভিত্তিক এই কমিটি পর্যায়ক্রমে গঠন করা হবে।
সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, কমিউনিটি পুলিশিং অবশ্যই প্রয়োজন। এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পুলিশের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা আছে। সেটা যেকোনো নামে বা ‘ফরম্যাটে’ হতে পারে। কারণ একটি দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাটসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা সম্ভব হয় না। তখন পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হয়। তাছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড়সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজনও হবে না।
থানার আইনশৃঙ্খলা ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম নিয়ে আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনির হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর কিছু মানুষের আইন না মানার প্রচলন শুরু হয়েছে। সেদিকটা গুরুত্ব মনে করে আনোয়ারায় আমরা যৌথবাহিনীর অভিযান জোরদার করেছিলাম। এর মধ্যে বিশেষ করে গরু চুরি বেড়ে গিয়েছিল। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এটি একদম নির্মূল করতে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেটা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতেছি। আশা করছি সেটি শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। আইন না মানার বিষয়টি বিশেষ করে লক্ষ্য করা গেছে কিশোর গ্যাং সদস্যদের । আমরা গত তিন মাসে ৩০জন কিশোর গ্যাং সদস্যদের আটক করে আদলতে প্রেরণ করেছি। মাদক ও জুয়ার আসর বন্ধ করতে পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। মূলত আমাদের কাজ নাগরিক সমাজের সাথে। আমরা রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখছি। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখছি। মূলত নাগরিক সমাজের সহযোগিতা বা ভূমিকা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য কমিউনিটি পুলিশিং খুবই কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সেটা মাঠ পর্যায়ে পুরোদমে কাজ করতে পারব বলে আশা করছি। বিশেষ করে আমরা থানাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এসবের ফলে আইনশৃঙ্খলা ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে।
বিএনএনিউজ/ বাবর/এইচমুন্নী