বাংলার মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতিকে পঙ্গু করার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চলে এসেছে চব্বিশ বছর ধরে, পরাধীন বাংলার শেষ সুবেদার মোনেম খানের আমলের একটি ঘটনায় তার একটি সুন্দর চিত্র পাওয়া যাবে। দুরন্ত প্রতাপশালী গভর্নর মোনেম খান একদিন লাটভবনের দরবার কক্ষে ডেকে পাঠালেন ঢাকার কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। এ এত্তেলা পেয়ে হাজির হলেন সকলে। তাদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা, অধ্যক্ষ মুহম্মদ আব্দুল হাই, আবুল হাশিম, কবি জসীমুদ্দীন এবং অন্যান্য। হুকুম করলেন গভর্নর : কি লেখাপড়া করেছেন আপনারা? রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না?’ জবাব দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহম্মদ আব্দুল হাই। বললেন : না, পারি না। আমরা কি করে রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখবো? আমরা লিখলে তো তা হবে হাই সঙ্গীত, জসীম সঙ্গীত….।
লজ্জায় অপমানে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন গভর্নর। জারি করলেন দ্বিতীয় নির্দেশ- বাংলা ভাষাকে ইসলামী রূপ দিতে হবে। এবার জবাব দিলেন অবিভক্ত বাংলার খ্যাতনামা রাজনৈতিক- মুখের উপর চিৎকার করে বলেছিলো বাংলার ছাত্র-তরুণের দল- ‘না, তোমার কথা মানি না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে’। বিদ্রোহী বাঙালীর সেই কন্ঠস্বর নুরুল আমিনের বুলেটও স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের দল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার স্বীকৃতি আদায় করে এনেছেন। রক্তের অক্ষরে লিখিত হয়েছে বাংলাভাষা আর বাঙালীর বিজয়গাঁথা।
কিন্তু পশ্চিমা শাসকের দল কোনদিন এই সত্যকে সহজভাবে স্বীকার করে নিতে পারেনি। বাংলা আর বাঙালী কথা দুটি ওদের অনুভূতিতে প্রতিনিয়ত ছড়িয়েছে বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা। তাই অবিরাম হামলা চলেছে বাঙালী জাতীর ওপর। ওরা আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখতে চেয়েছে, হাওয়াই হামলা করেছে, ভাষাটাকে মুসলমানী চেহারা দেবার জন্য তার মাথায় টুপি পরিয়ে দিয়েছে। ‘কৃষ্টি সংস্কৃতি’ কে করা হয়েছে ‘তাহজীব-তমদ্দুন’। নজরুলের কবিতায় ‘শ্মশান’ কেটে করা হয়েছে ‘গোরস্থান’। কায়কোবাদের লেখা ‘মহাশ্মশান’ বইখানির নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে ‘মহা-গোরস্থান’।
কিন্তু কি লাভ? মি: জিন্নাহ থেকে মোনেম খাঁ যা পারেনি- ইয়াহিয়া-টিক্কাও তা পারবে না। ইতিহাসের গতি পশ্চাদমুখী নয়, ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘোরে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখের ভাষা আর তাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনাকেও কেউ জোর করে হত্যা করতে পারবে না।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ১০৬) চলবে।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭৫
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা