।।ইয়াসীন হীরা।।
দুই মাস আগে ‘ফখরুলের স্বপ্ন: বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে!’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেছিলাম বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না, বরং সিংগাপুর হবে। এ মন্তব্যের সত্যতা মিলেছে সম্প্রতি কানাডা ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ‘The $100 Trillion World Economy Global GDP 2022’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। শুধু তাই নয়,প্রতিবেদনে এমন তথ্য ওঠে এসেছে আগামীতে সিংগাপুরকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ!
কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ‘গোয়েবলসীয় পলিটিক্স’ শুরু করেছে।
এখানে বলে রাখি, পল জোসেফ গোয়েবল্স একজন রাজনৈতিক। এডলফ হিটলারের প্রধান সহযোগী এবং তার একনিষ্ঠ অনুসারী। ১৯৩৩ হতে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী ছিলেন । বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা এবং কাল্পনিক তথ্য ও মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। গোয়েবল্স একটি মিথ্যাকে বারবার বললে সেটি সত্যে পরিণত হয় এবং লোকে বিশ্বাস করতে শুরু করে।
এ বিষয়ে আলোচনা করার আগে ‘The $100 Trillion World Economy Global GDP 2022’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতি সর্ম্পকে কী বলা হয়েছে তা আলোচনার দাবি রাখে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারি শুরুর আগ পর্যন্ত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বেড়েই যাচ্ছিল। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিজনেস সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতি ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
২০২০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির আকার ছিল ৮৮ ট্রিলিয়ন এবং ২০২১ সালের তা ছিল ৯৪ ট্রিলিয়ন। আইএমএফ এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ এর শেষ দিকে এটি হবে ১০৪ ট্রিলিয়ন। এটি নতুন মাইলফলক। যা এর আগে ইতিহাসে কখনো হয়নি।
তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইরাক-সৌদি আরবসহ তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জিডিপি বাড়ছে। একই সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলির জিডিপি বাড়ছে। তবে ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশ এবার করোনা মহামারি এবং যুদ্ধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
‘The $100 Trillion World Economy Global GDP 2022’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৪.৪ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল কিন্তু এটি ৩.৬ শতাংশের উপরে বাড়বে না বলে মনে হচ্ছে। জিডিপি এর দিক থেকে বিশ্বের সেরা ১০টি অর্থনীতির দেশ হচ্ছে আমেরিকা, চায়না, জাপান, জার্মানি , যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স, কানাডা, ইটালি ও ব্রাজিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির আকার ২৫.৩ ট্রিলিয়ন। চীনের এটি ১৯.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ইউরোপের মধ্যে জার্মানি সব থেকে এগিয়ে আছে এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে মনে হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে চীন প্রথম স্থান দখল করে নেবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির ‘মোড়ল’ হবে দেশটি।
এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, পতুর্গাল,নিউজিল্যান্ড, রোমানিয়া, চেচনিয়া, ইরাক, ফিন্ডল্যান্ড,চিলি, কলম্বিয়া, হংকংকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৯৩ টি দেশের মধ্য বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। এর আগের বছর ছিল ৪২তম। যেখানে সিংগাপুরের অবস্থান ৩৭তম। বাংলাদেশের রির্জাভ ৩৯.৭ বিলিয়ন ডলার আর সিংগাপুরের রিজার্ভ ৪২.৪ বিলিয়ন ডলার।
করোনা মহামারি,রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে! যদিও রিজার্ভ কমেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়- সারাবিশ্বের একই অবস্থা। যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ তাতে ২০৩৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবস্থান হবে ২৪তম। । ২০৩৬ সাল নাগাদ দেশের জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএনপির শাসনামলে ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার জমা হয়। জাতীয় পার্টির আমলে ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কোন দল। পরে জামায়াত ইসলামীর সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয় বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে রিজার্ভ এর পরিমাণ দাড়ায় ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়।
১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতাসীন হন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে রিজার্ভ আবারও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এসময় রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার ।
চার দলীয় জোট সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হারানোর আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার ।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-২০০৮) অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬.১ বিলিয়ন ডলার।
২০০৮ সালে আবারও ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। পরের বছর ২০০৯-১০ অর্থবছরে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে রিজার্ভ দাড়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলার । এরপর থেকে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশ। ২০১৫- ২০১৬ রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেনি বরং বেড়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৯৯ কোটি ডলারের আমদানি দায় পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
বাংলাদেশর গণমাধ্যম সমূহ এ সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। আর যায় কোথায়?
বিএনপি’র মূখপাত্র রুহুল কবির রিজভী পরদিনই সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে, তথাকথিত উন্নয়নের মাধ্যমে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে, দেশ থেকে লাখ-লাখ কোটি টাকা পাচার করে অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তলানীতে ঠেকেছে- যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।’
আসলে কী তাই? নাকি সরকারের বিরোধীতা ও জনগণকে মোটিভেশন করতে রুহুল কবির রিজভী ‘গোয়েবলসীয় পলিটিক্স’ এর আশ্রয় নেন? রুহুল কবির রিজভী বুঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমেনি। বরং বেশিই ছিল। বিএনপি ও জামায়াতের শাসন আমলের রেখে যাওয়া রিজার্ভ দূর্নীতি, লুটপাটের মাধ্যমে খেয়ে ফেলেছে!
বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী ‘গোয়েবলসীয় পলিটিক্স’ এর অংশ হিসেবে সংবাদ সম্মেলেনে জানিয়ে দিলেন ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ‘তলানিতে’ ঠেকেছে- যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।’
হিটলারের তথ্যমন্ত্রী “দ্য লিটল ডক্টর” নামে পরিচিত গোয়েবলস প্রোপাগান্ডা শব্দটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি ছিলেন দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী। তার ডান পা ছিল বাম পা অপেক্ষা মোটা এবং ছোট। আর এই শারীরিক অক্ষমতার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু গোয়েবলস সেই দুর্বলতা দূর করেছিলেন তার তুখোড় ভাষণ ও লেখনী শক্তি দ্বারা। মূহুর্তে তিনি তিলকে তাল বানাতে পারতেন!
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন মিথ্যা ও কাল্পনিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীতা করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পল জোসেফ গোয়েবল্স এর পথেই হাঁটছে!