বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খন্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভান্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে। ১ মার্চ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেপথ্যে গণ মাধ্যমের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
আজ প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৮
১০জুন, ১৯৭১
হংকং- এর ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে:
দৈনিক ডন এবং দৈনিক পাকিস্তান টাইমসহ পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা স্বীকার করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান ও মি: জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আলোচনা চলাকালে একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ একথা প্রচারও করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের চারটি যুক্তিসঙ্গত দাবী মেনে নিয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের এই চারটি দাবী হলো:
এক- সামরিক শাসন তুলে নেয়া।
দুই- সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া।
তিন- নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া।
চার- সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র জনসাধারণ হত্যার তদন্ত করা।
এই দাবীগুলো মেনে নেয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিতান্ত গোপনে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বিমানযোগে করাচী ফিরে গেলেন। এবং আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করে ও পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর সশস্ত্র সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এর কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও প্রেসিডেন্ট দিতে পারলেন না। এতে পরিস্কার ভাবে বোঝা গেল যে, আলোচনার নামে সময় নিয়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলায় সৈন্য আমদানী করলেন- যাতে বাংলাদেশের অধিকার-সচেতন মানুষ ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর সামনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ সকল কারণে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর প্রতি সকলে সন্দেহ পোষণ করলো।
কানাডার দৈনিক মনট্রিল স্ট্রিট পত্রিকায় বলা হয়েছে:
ঢাকার ব্যাপক গণহত্যা পরিকল্পনায় স্বয়ং ইয়াহিয়া খানসহ পাক-সেনাবাহিনীর সব জেনারেল জড়িত ছিলো। মূলত গৃহযুদ্ধ দমনের পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় এই জেনারেলরা পুরোপুরি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এই হত্যাযজ্ঞ কেবলমাত্র টিক্কাখানের নিজস্ব ও একক উদ্যোগ নয়- এটা আসলে খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে সংঘটিত একটি মিলিটারি অভিযান। বাঙালী হত্যার সামরিক আদেশ সেনাবাহিনীর সকল ইউনিট কমান্ডারের কাছে যাতে প্রত্যক্ষভাবে এবং লিখিতভাবে পৌঁছে সেজন্য প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চ বিকেল দুটো পর্যন্ত নিজেই খোঁজখবর নিয়েছেন। সন্ধ্যে সাতটায় প্রেসিডেন্ট বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন। রাত এগারোটায় ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার গানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়।
জাপানের ডেইলী জাপান টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে : পূর্ব বাংলায় পাক-সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণেই এক রক্তক্ষয়ী অভিযান চলছে। জাপানের আসাহি শিমবুন পত্রিকা বলেছেন, বাংলাদেশে নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেখানে যে নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, তা নজিরবিহীন।
নেপালের দি নিউ হেরাল্ডপত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে : পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্র পূর্ব বাংলায় যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে এবং গণজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে তাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের প্রতি বিশ্ববাসী সহানুভূতি দেখিয়েছেন। মুক্তিকামী জনতাকে এভাবে হত্যার ফলে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক চিরতরে তিক্ত হয়ে গেল। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর কাণ্ডকারখানার দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়ে গেছে যে পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এবং তারা প্রাণ দিচ্ছেও।
তুরস্কের দি ডেইলী জুনাইদিন পত্রিকা মন্তব্য করেছেন যে, একদিকে প্রায় এক লক্ষ সুসংগঠিত, সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য, অপরদিকে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সকল বাঙালীকে কখনো কতল করতে পারবে না। বাঙালীর মুক্তি অবধারিত।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – ৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৫৫-৫৬) চলবে।
আরও পড়ুন :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-১০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০১
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা