26 C
আবহাওয়া
৯:৫১ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ৫, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » নবীর ভালোবাসা-ই ক্ষত-বিক্ষত মুসলিম জাতিকে মুক্তি দিতে পারে

নবীর ভালোবাসা-ই ক্ষত-বিক্ষত মুসলিম জাতিকে মুক্তি দিতে পারে

masjid nabwi madina

।।সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী।।
সমগ্র মুসলিম জাতি আজ দ্বিধা-বিভক্ত! হবেই না কেন? কেউ বলে ডানে চলো, কেউ বলে বামে, কেউ বলে সামনে, কেউ বলে পিছনে। একজন মুসলমান এখন যাবে কোন দিকে? প্রত্যেক মতের প্রবর্তক বা শীর্ষ ব্যক্তিরা নিজ নিজ মতের উপর বেশ দক্ষতার সাথে যুক্তিও দিয়ে যাচ্ছে। মনে হবে যেন প্রত্যেকেই সঠিক কথা বলছে।

তাহলে একজন সাধারন মুসলমান যিনি সত্যিই আল্লাহ-রাসূলকে বিশ্বাস করে সঠিক পথে চলার চেষ্টা করেন, তিনি কী করবেন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালো করেই জানেন মুসলমানগন এই ধরনের সমস্যায় পড়বে। এ কারণে পবিত্র কুরআনুল করিমের শুরুতেই এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

সেটি কী? সেটি হল সূরা ফাতেহা। এই সূরা ফাতেহার মধ্যেই মানুষের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে সূরা ফাতেহার এত মর্যাদা। নামাজের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহা পাঠ করতেই হয়। সুরা ফাতেহাকে পবিত্র কোরানের সারমর্মও বলা হয়। হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে সুরা ফাতেহা নাযিলের সময় শয়তান কান্না করেছিল!

সুরা ফাতেহার মধ্যে মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উত্তর কিভাবে পাওয়া যাবে? এই সূরার ৫ নং আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন-আমরা যেন সিরাতাল মুস্তাকিম বা সরল সঠিক পথ পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আমরা পাঠ করি- ইহ্দিনাস সিরাতোয়াল মুস্তাক্বী-ম অর্থাৎ (হে আল্লাহ) আমাদেরকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত কর। আমরা আল্লাহর কাছে সরল-সঠিক পথ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি। কিন্তু সরল-সঠিক পথ কোনটা, আমরা কীভাবে চিনতে পারব? এই প্রশ্নের উত্তর পরবর্তী আয়াতের মধ্যেই রয়েছে- সিরা-তে¦ায়াল্লাযী-না আন্আমতা আলাইহিম অর্থাৎ তাঁদেরই পথে যাদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছো। যাদের কার্যক্রমের উপর সন্তুষ্ট হয়ে তুমি তাদেরকে কল্যাণের জন্য মনোনীত করেছ।

পরবর্তী প্রশ্ন আসে-মহান আল্লাহ কাদের কার্যক্রমের উপর সন্তুষ্ট? সেই প্রশ্নের উত্তরে নবীগনের পরে প্রথমে যাদের নাম আসে তাঁরা হলেন রাসূলুল্লাহর সাহাবীগণ। পবিত্র কোরআনে রাসূলুল্লাহর সাহাবীগণের শানে অসংখ্য আয়াত মহান রব্বুল আলামীন নাযিল করেছেন। এমনকি কোন কোন সাহাবীর কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে মহান আল্লাহ কুরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন- মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাঁদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে (সূরা তাওবা, আয়াত ১০০)। রাসূলুল্লাহর সাহাবীগণ যে সিরাতাল মুস্তাকিম এর উপর প্রতিষ্ঠিত আল্লাহর এই বাণীর মাধ্যমে নিশ্চিত করে বলা যায়।

এখন আমরা দেখি সাহাবীগণের আদর্শ কী ছিল। সাহাবীগণের মধ্যে যিনি এক নম্বরে আছেন, যিনি রাসূলুল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন তিনি হলেন হযরত সিদ্দীক আকবর (রা.)। এ কারণে তাঁকে আফজালুন-নাস বাদাল আম্বিয়া বলা হয় অর্থাৎ নবীগণের পরে সকল উম্মতের মধ্যে তিনি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি উত্তম, সম্মানিত। সিদ্দিক আকবর (রা.)-র শানে পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন- যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিলো, তিনি তার সঙ্গীকে বললেন, তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন (সূরা তাওবা, আয়াত ৪০)। এখানে হিযরতের রাতে গারে সাওর এর গুহায় রাসূলুল্লাহ (দ.) ও সিদ্দিক আকবর (রা.) এর অবস্থানের কথাটি মহান আল্লাহ উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন হল সিদ্দীকি আকবর (রা.)-র এত মর্যাদা কেন? তিনি কি সবচেয়ে বেশি নামাজ, রোজা ইত্যাদি এবাদত করেছেন? কীভাবে করবেন, তিনি তো নবীজির প্রায় সমবয়সী ছিলেন। নবীজির ইন্তেকালের মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনিও ইন্তেকাল করেছেন (ত্রয়োদশ হিজরী)। তাহলে তিনি তো অনেক বছর এবাদত বন্দেগী করার সুযোগও পাননি এরপরেও এত মর্যাদার অধিকারী কিভাবে হলেন? পূর্বেই বলা হয়েছে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সাহাবী। একটি ঘটনার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব তিনি কীভাবে রাসূলুল্লাহ (দ.)-র এত প্রিয় হয়েছিলেন।

হিযরতের সময় আসন্ন। রাসূলুল্লাহ(দ.) তাঁকে ইঙ্গিত দিলেন- যেকোন রাতে মদিনায় হিজরত করতে হবে। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর সত্যিই একদিন হিজরতের রাত চলে এলো। গভীর রাতে রাসুলুল্লাহ (দ.) সিদ্দীক আকবরের(রা.)-ও ঘরের সামনে এসে ডাক দিলেন। ডাকার সাথে সাথে সিদ্দিক আকবর জবাব দিলেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ (দ.)। আশ্চর্য ব্যাপার! এত গভীর রাতে কোন মানুষকে ঘরের বাইরে থেকে ডাকলে অন্তত কয়েকবার ডাকতে হয় তারপর উত্তর পাওয়া যায়, ঘরের দরজা খোলা হয়। আর সিদ্দীক আকবর (রা.)-কে ডাক দেয়ার সাথে সাথে সাড়া দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দুইবার ডাকার প্রয়োজন হল না।

হযরত জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার সিদ্দীক, তুমি ডাকার সাথে সাথে কীভাবে সাড়া দিলে? জবাব দিলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (দ.) হিজরতের কথা আপনি যে দিন আমাকে বলেছিলেন সেদিন থেকে আমি একটি রাতও ঘুমাইনি কারণ-কখন যে আপনি এসে ডাক দিবেন এজন্য আমি সারারাত দরজার সামনে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতাম যেন আমার ঘুম চলে না আসে!

দেখুন নিজ পয়গাম্বরের প্রতি কেমন আস্থা, আনুগত্য, ভালোবাসা! পৃথিবীর ইতিহাসে গুরু-ভক্তির এমন নজির পাওয়া যাবে না। সিদ্দীক আকবর (রা.)-র রাসুলুল্লাহর প্রতি এমন আনুগত্য, ভালোবাসার বর্ণনা বলে শেষ করা যাবেনা! ওলামা কেরাম এই বিষয়ে অসংখ্য লিখেছেন। তবু যেন এখনো সিদ্দীক আকবর (রা.)-র বিষয়ে আরো অনেক কিছু বলার রয়ে গেছে।

সম্মানিত পাঠক, ইতোমধ্যে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন-রাসূলুল্লাহ-র সাথীগনের এত তেজোদীপ্ত ঈমানের কারণ রাসূলুল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা। হবেই না কেন? মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সমগ্র জায়গায় রাসুলুল্লাহর আনুগত্য করার জন্য বলে দিয়েছেন। যেখানেই বলেছেন আতিউল্লাহা সেখানেই ওয়া আতিউর-রাসুল বলেছেন অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। এমনকি রাসূলুল্লাহর সামনে উচ্চস্বরে আওয়াজ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ ঘোষণা করেন-হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উচ্চ করো না এবং তোমরা নিজেরা যেমন উচ্চস্বরে কথা বলো তাঁর সাথে সে রকম উচ্চস্বরে কথা বলো না (সূরা হুজুরাত আয়াত-২)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন- রাসুল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ করো আর যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও (সূরা হাশর, আয়াত ৭)। সুতরাং আমরা এতক্ষণে নির্দ্বিধায় বলতে পারি নবীর প্রতি মহব্বত, ভালোবাসা-ই হলো সিরাতুল মুস্তাকিম এর পথ। এ কারণে রাসূলুল্লাহ বলেছেন- যারা আমি ও আমার সাহাবীগণের পথে থাকবে তারাই একমাত্র নাজাত প্রাপ্ত দল (সুনান ইবনে মাজাহ)।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মুসলমানদের ঈমানকে দুর্বল করার জন্য ইসলামের একেবারে প্রথম থেকেই ইহুদি চক্রান্ত চলতে থাকে। এই ইহুদি চক্র ভালোভাবেই বুঝতে পারে মুসলমানদের ইমানী শক্তি হলো তাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা। তাই ইহুদীরা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবীর রেসালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। এই কাজ করার জন্য তারা যথেষ্ট গবেষণাও করে থাকে, কিছু মানুষকে আলেম সাজিয়ে বা কিছু আলেমকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টিতে লাগিয়ে দেয়। এই পর্যন্ত তারা এ কাজে বেশ সফল। কাজেই এই বিষয়ে মুসলমানদের সজাগ থাকা অতীব জরুরী।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিউজে দেখলাম ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে একদল শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে বলা হয়-“আমরা আমাদের মহানবীকে ভালোবাসি, এ কথাটা সর্বত্র উচ্চারিত হোক” (সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, অনলাইন) তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাই আসুন আমরা বলি-“আমরা আমাদের নবীকে ভালোবাসি”। জাতির দুর্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে পথ দেখিয়েছে। মুসলমানদের এই ক্ষত-বিক্ষত সময়েও তাদের এই আহ্বান দ্বিধা-বিভক্ত মুসলমানদের পথ দেখাতে পারবে। ইন শা আল্লাহ।

নবীকে ভালোবাসার মাধ্যমে শান্তি বয়ে আসুক সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে। এতে শান্তি বয়ে আসবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।

সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী
সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (দর্শন), বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)

 

 

 

 

 

Loading


শিরোনাম বিএনএ