বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান করে দুর্নীতিবাজদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন দুদকের কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। তার জালে আটকা পড়তে হয়েছে সরকারি বড় কর্তা থেকে ছোট কর্মচারি, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থেকে এলাকার পাতি নেতাকেও। একের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও সম্পদের অনুসন্ধান করা হয়। চৌকস এ কর্মকর্তার সাহসিকতায় চলতি সপ্তাহে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির ঘটনায় দুই কাউন্সিলর, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মামলা দায়ের করা হয়। তার কারণে কোন স্থানই ফাঁক দিয়ে গলতে পারেনি দুর্নীতিবাজরা। তার সাহসী অভিযান ও পদক্ষেপে দুর্নীতিবাজদের ভীত নড়ে গিয়েছিল। তবে অভিযানের রেশ কাটতে না কাটতেই তাকে বদলি করা হলো চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে। হঠাৎ করে তার বদলিকে রীতিমতো রহস্যময় দেখছে চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ।
বুধবার (১৬ জুন) দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা কার্যালয় পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছে। তার স্থলে সংযুক্ত করেছে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপ সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলামকে।
আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দীন সর্বশেষ আজ (বৃহস্পতিবার ১৭ জুন) অবৈধ উপায়ে রোহিঙ্গা নাগরিককে জাতীয় সনদপত্র (এনআইডি) প্রদান এবং পাসপোর্ট আবেদনে সহায়তা করার অভিযোগে ৩ পুলিশ পরিদর্শক, ইসি কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এরআগে ১৬ জুন হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অর্ন্তভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন এবং ১২ জুন ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ। এনআইডি জালিয়াতির ঘটনাতেও আরও ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। তাতেও আসামি করা হয় ইসির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারিকে। যারমধ্যে অর্ধেকের বেশি বাদি এ কর্মকর্তা।
এরবাইরে গেল সপ্তাহে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্টিবিউশনের এক জিএমকে গ্রেপ্তার ও সাবেক মন্ত্রিপুত্রকে আসামি করে মামলা দায়ের করার ঘটনাতেও আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দিন। কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রীর মেগা প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতির ঘটনাতেও কাউন্সিলর, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্তত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেন এ কর্মকর্তা। একই সাথে সরকারি জমি উদ্ধারসহ দুর্নীতির প্রায় ৫০ কোটি টাকা জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন এ কর্মকর্তা। দুর্নীতিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে একের পর এক চমক দেখালেও শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছাড়তে হয়েছে এ কর্মকর্তাকে।
দুদকের সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি ও প্রভাবশালী নেতাদের দ্বারা টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যের তদন্তও করছেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। যাতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দালিলিক প্রমাণও মিলেছে ইতোমধ্যে। তদন্তকালেই চমেক হাসপাতালের অবৈধভাবে থাকা ক্যান্টিন-গ্রোসারিশপের ইজারার অর্থ জব্দ করে সরকারি কোষাগারে দেন এক কর্মকর্তা। এ বছরের মার্চে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে খালাসি পদে ১৯ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন শরীফ উদ্দীন। একই মামলায় দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত খালাসি, ঠিকাদার, স্কুল শিক্ষক, পিয়ন, রেলের ড্রাইভারসহ আরও ৮ জনকে আসামি করা হয়। সবশেষ গেল ১০ জুন অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলকারী সংগঠকরা বলছেন, এই সময়ে তার বদলির ঘটনাটি সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত হয়নি। স্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ন্যায়নীতি ও গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ অবশ্যই হুমকিস্বরূপ। তবে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, শরীফ উদ্দিনের এই বদলি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক ও টিআইবির সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ক্ষমতাশীলদের আইনের আওতায় আনার কারণেই তাকে এই ফল ভোগ করতে হচ্ছে এমনটা মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও সরকারি চাকরিতে বদলির নিয়ম আছে। তবে সাবেক মন্ত্রিপুত্র ও বেশ কয়েকজন আলোচিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার পর এই কর্মকর্তাকে বদলি করা একেবারে উচিৎ হয়নি। এতে করে কর্মকর্তাদের মনোবলে আঘাত লাগে। যদি এই বদলিটি রুটিন ওয়ার্কও হয় তবু দুদকের এই বদলি আদেশ দেওয়া উচিত হয়নি। এই সময়ে তার বদলির ঘটনাটি সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত হয়নি। স্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ন্যায়-গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ অবশ্যই হুমকি স্বরূপ।
এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ বলেন, যাদের কর্মক্ষেত্রে আড়াই থেকে ৩ বছরের ঊর্ধ্বে অতিবাহিত হয়েছে, তাদের বদলি করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক বদলি। কাজের গতি আনতেই এই রুটিন ওয়ার্ক।
শরীফ উদ্দিনের বদলির বিষয়ে তিনি বলেন, সে ভালো কাজ করছে। কমিশন অনুমোদন না দিলে সে তো মামলা করতে পারতো না। অনুমোদন পাওয়ার পরই সে মামলা করেছে। মামলা করার কারণেই যে সে বদলি হয়েছে, এটা সঠিক নয়। এটা পুরোপুরি আলাদা বিষয়।
প্রসঙ্গত, বুধবার বিকেলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ২১ কর্মকর্তাকে প্রধান কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন দুদক অফিসে বদলি করা হয়েছে। তাদেরকে ১ জুলাইয়ের মধ্যে বদলিকৃত স্থানে যোগদান করতে বলা হয়েছে।
যাদের বদলি করা হয়েছে তারা হলেন- দুদকের প্রধান কার্যালয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ বিভাগের উপসহকারী পরিচালক বিলকিস আক্তারকে মানিলন্ডারিং শাখায়, অনুসন্ধান ও তদন্ত-৪ বিভাগের আবু নছরকে একই কার্যালয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত-৬ বিভাগে, অনুসন্ধান ও তদন্ত-৬ বিভাগের মো. জসীম উদ্দীন গাজীকে অনুসন্ধান ও তদন্ত-৪ বিভাগে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ শাখার মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজকে বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে, প্রধান কার্যালয়ের মানিলন্ডারিং শাখার সোমা হোড়কে অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ শাখায় এবং উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালামকে ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এ বদলি করা হয়েছে।
অন্যদিকে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপসহকারী পরিচালক নুর আলম সিদ্দিকী দুদকের প্রধান কার্যালয়ের মানিলন্ডারিং শাখায়, সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর মো. নজরুল ইসলামকে রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে, ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সাধন চন্দ্র সূত্রধর এবং জিতেন্দ্র নাথ সাহাকে পাবনা ও টাঙ্গাইলে, টাঙ্গাইলের রাজু মো. সারোয়ার হোসেনকে ময়মনসিংহের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে, রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের মো. কামিয়াব আফতাহি-উন-নবী ও সরদার আবুল বাসারকে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে ও ফরিদপুরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে, রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের মো. নুর আলমকে বগুড়ায়, চট্টগ্রাম-১ এর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের নুরুল ইসলামকে চট্টগ্রাম-২ এ এবং চট্টগ্রাম-২ এর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের মো. শরীফ উদ্দিনকে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. ফয়সাল কাদের ও নীল কুমল পালকে চট্টগ্রাম-১ ও কুষ্টিয়ায়, কুষ্টিয়ার মো. নাছবুল্লাহ হোসাইনকে চট্টগ্রাম-১ এবং বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের মো. আল-আমীনকে খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।
বিএনএনিউজ/মনির