।। রেহানা ইয়াছমিন।।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে বলা হয় ‘প্রেডিক্টেবলি আনপ্রেডিক্টেবল’। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত! জাতীয় পার্টির নেতাদের যে, কোনো স্থিরতা নেই, তা এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।জাতীয় পার্টির নেতারা সকালে বলেন এক কথা। দুপুরে বলেন এক কথা। আবার সন্ধ্যা কিংবা রাত হতেই বদলে যায় তাদের মত।

বর্তমানে জাতীয় পার্টির এই চরিত্র এখন ধারণ করেছে সরকারি দলের তকমা পাওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি অবার কখনো জামায়াত ইসলামীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেকে সুবিধাবাদী একটি চরিত্রে মেলে ধরেছে।
গত ৪ মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপি’র সমালোচনায় মূখর ছিল এনসিপি। আওয়ামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও, শাহবাগে অবরোধকালেও এনসিপি নেতারা বিএনপিকে তুলোধুনা করে।জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য’-এর ব্যানারে সংঘটিত এ আন্দোলনে অংশ নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল ও সংগঠন।
বিএনপিবিহীন এ আন্দোলনে অংশ নেয় জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, আপ বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিসসহ অন্য দলগুলো। টানা তিন দিন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ১০ মে রাতে।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের উৎসব ছাপিয়ে সমাজমাধ্যমের ইস্যু হয়ে ওঠে আন্দোলন চলাকালে ছাত্রশিবিরের নেতাদের দেওয়া ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান। পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবেশনকালে ইসলামপন্থি দলের কতিপয় কর্মীর দ্বারা বাধা প্রদানের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।
মধ্যপন্থি দল হিসেবে পরিচিত এনসিপি নেতারা পড়েন বিতর্কের মুখে। ওইদিন রাতেই অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা এবং জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ডখ্যাত সমন্বয়ক মাহফুজ আলম ফেসবুকে ‘দুটি কথা’ শীর্ষক একটি পোস্ট দেন। সেখানে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জামায়াত ইসলামীর কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেছেন, ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীদের ঠাঁই হবে না।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। পাল্টা জবাব দিতে ছাড়ছেন না জামায়াত-শিবির নেতারাও। এ নিয়ে ফেসবুকসহ নানান মাধ্যমে তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে পক্ষ দুটি। জুলাই গণ অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে মিত্র হিসেবে পরিচিত পক্ষ দুটির মধ্যে সম্পর্কের এ টানাপোড়েন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানান আলোচনা।
জুলাই আন্দোলনের সহযোগী জামায়াত ইসলামীর প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)র এমন কটাক্ষমূলক মনোভাব রাজনীতিতে ঝড় ওঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে কাছে পেতে এবং তাদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে চায় এনসিপি।
এনসিপি সূত্র জানায়, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠিত এনসিপিকে বিএনপি এবং জামায়াতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। শুরুতেই বিএনপির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে এনসিপি। এদিকে জামায়াতের সঙ্গে লিখিত কোনো জোট না থাকলেও বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল এনসিপির। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ডানপন্থি দল হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেছিল বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি।
সর্বশেষ শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। এনসিপির নেতৃত্বে হওয়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে লোকবল ও সমর্থন দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে জামায়াত। কিন্তু একটি সর্বদলীয় প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত হওয়া এ আন্দোলনে জামায়াত-শিবির কর্মীরা দলীয় স্লোগান দিয়ে ও সংগীত গেয়ে এনসিপিকে বিতর্কের মুখে ফেলে দিয়েছেন। জামায়াত-শিবির কর্মীদের এহেন কর্মকান্ড তাদের নিজেদের বিতর্কিত রাজনৈতিক ইতিহাসও পুনরায় জাতির সামনে তুলে এনেছে।
সব মিলিয়ে জামায়াতের ডানপন্থি রাজনীতির ছায়াতল থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মধ্যপন্থি রাজনীতির আদর্শিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার বয়ান তৈরি করতেই দলটির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে এনসিপি।মাহফুজের এ পোস্টের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান জামায়াত ও শিবির নেতা-কর্মীরা। শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক।
এই বিতর্ক শেষ না হতেই রোববার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে আরেকটি পোস্ট দেন মাহফুজ আলম। তবে পোস্ট দেওয়ার ৩ মিনিটের মাথায় তিনি সেটি সরিয়ে ফেলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সে পোস্টের স্ক্রিনশট।
সে পোস্টে মাহফুজ আলম পাকিস্তানপন্থিদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই আঘাত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন।
এ পোস্টের পর জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। সরকারের দায়িত্বশীল পদে থাকা অবস্থায় একটি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দাবি করে তাঁর বিরুদ্ধে ‘শপথভঙ্গের’ অভিযোগও করেন তাঁরা। শাহবাগ থানা জামায়াতের আমির শাহ মাহফুজুল হক এক টিভি অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলম ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হয়ে কাজ করছেন কি না সে প্রশ্ন তোলেন।
এ দিকে এনসিপি নেতাদের বক্তব্য ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়ে গত সোমবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শীর্ষ নেতাদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মঙ্গলবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।
জামায়াত ইসলামী মনে করে, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা রক্ত ঝরিয়েছে, জীবন দিয়েছে সে স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এ পর্যায়ে এ ধরনের পুরোনো কাসুন্দি বা বিভাজনমূলক কথা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের এক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘তথ্য উপদেষ্টা ফেসবুকে যে পোস্ট দিয়েছেন সেটা কার বা কোন দেশের পক্ষে? আমরা পাকিস্তানপন্থিও না ভারতপন্থিও না। এসব দেশের পন্থি হওয়ার জন্য আন্দোলন করিনি। জনগণের কল্যাণের জন্য আমরা মাঠে ছিলাম। দেশ এগিয়ে নেওয়ার জন্য সামনের দিনেও একসঙ্গে মাঠে থাকতে চাই।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন জাতীয় নাগরিক পাটি (এনসিপি) ও জামায়াত ইসলামীর মধ্যে যে দুরত্ব তৈরি হয়েছে তার বেনিফিসারি বিএনপি। এনসিপি চায়, বিএনপির সঙ্গে সুম্পর্ক। তারই ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত এনসিপির সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী সমোঝতা বা জোট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিএনএ