।।ইয়াসীন হীরা।।
কবে ইয়াবার বাণিজ্য শুরু হয়েছিল? অনুসন্ধানে এ ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য শুরু হয়। এর দুই বছর পর সীমান্ত বাণিজ্যের আড়ালে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার প্রথম চালান আসে। এটি এনেছিলেন টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল করিম। ট্রানজিট ব্যবসার আড়ালে সাইফুল কোটি কোটি টাকার ইয়াবা এনেছেন!
সেই সময়ে কিছু অভিজাত পরিবারের উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা অনেকটা শখ করে ইয়াবা সেবন করতো। পরবর্তীতে সীমান্ত বাণিজ্যের আড়ালে সাইফুল করিম একচেটিয়া ইয়াবা চালান আনা শুরু করেন।
সীমান্ত বাণিজ্যের নামে বৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে কক্সবাজার জেলা থেকে সর্বোচ্চ কর দিয়ে তিনি অর্জন করেছিলেন সিআইপি (বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) মর্যদা! সেই সূত্রে দেশের বিভিন্ন এলিট শ্রেণির ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। আর এ সখ্যতার মাধ্যমে সাইফুল করিম ইয়াবা ব্যবসার একটি গ্রুপের গডফাদার হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশে ইয়াবা আগ্রাসনের জনক সাইফুল নিজের নামের আগে ‘সিআইপি’ তকমা লাগান। এর মধ্য বেশ কয়েকবার হজ্বও করেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সবার কাছে সিআইপি হাজী সাইফুল নামে বেশ পরিচিত ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকনাফ স্থলবন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যের আড়ালে চলত তার ইয়াবা বাণিজ্য। তার প্রতিষ্ঠানের নাম এস.কে. (সাইফুল করিম) ইন্টারন্যাশনাল। কথিত সিআইপি হাজী সাইফুল করিম মিয়ানমারের মংডু থেকে আমদানি পণ্যের সঙ্গে দেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। এই চালান সারাদেশে পাচার করার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিল তার। সাইফুল টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করতেন।
সাইফুল করিমের ইয়াবা সিন্ডিকেট মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই সিন্ডিকেটের সদস্য। তাদের সবাই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সাইফুল প্রায় সময় দুবাই, ইয়াঙ্গুনে থাকলেও তার ইয়াবা কারবার চলছিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির সঙ্গে ছিল সাইফুলের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে সীমান্ত এলাকা টেকনাফে ছিল তার প্রভাব প্রতিপত্তি।
২০১৮ সালের ৩ মে’ র আগে চট্টগ্রামের হালিশহরে ১৩ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় প্রথমবার ইয়াবা ব্যবসার সাথে সাইফুল করিমের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ পায়। এ সময় মোহাম্মদ আশরাফ আলী ও হাসান নামে দুই সহোদরকে আটক করে চট্টগ্রাম মহানগর ডিবি পুলিশ। পরে রাশেদ মুন্না নামের একজন আটক হয়। এর মধ্য আশরাফ ও রাশেদ মুন্না আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দীতে মিয়ানমারের রহিম ও সাইফুল করিম, শওকত আলম ইয়াবাগুলোর মালিক বলে জানায়। উল্লেখ, ৪ বছর পর ২০২২ সালের ২ জুলাই পিআইবি হাটহাজারীর বাসিন্দা শওকত আলমকে আটক করতে সক্ষম হয়।
সাইফুল করিমের পরিচয়!
মিয়ানমার ও বাংলাদেশে ‘এস.কে. নামে পরিচিত ছিলেন সাইফুল করিম। কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার শীলবুনিয়াপাড়ায় তার জন্ম। তার পিতার নাম মোহাম্মদ হানিফ। তিনি পেশায় ছিলেন পল্লী চিকিৎসক।তাদের আয়ের উৎস ছিল একটি ফার্মেসী। সীমান্ত বাণিজ্যের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসায়-ই যেন ‘আলাদীনের চেরাগ’ পেয়ে যান সাইফুল।
সাইফুল করিম বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে তিনি চট্টগ্রাম এম.ই.এস. কলেজে পড়াশোনা করতেন। তখন থেকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পরিবার নিয়ে থাকতেন কোতোয়ালি থানার কোরবানিগঞ্জ এলাকায়। এই সময়েই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন সাইফুল।
চট্টগ্রামের নামিদামি পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। বন্ধু এবং পরিচিতদের ‘অফার’ দিতে শুরু করেন। অনেকে তার প্রলোভনে সাড়া দিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই ইয়াবা ব্যবসায় বিশাল এক সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন । আর স্বল্প সময়ের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক বনে যান সাইফুল করিম।
সাইফুলের ৩ ভাই ও ভগ্নিপতি সাংবাদিক!
সাইফুলের তিন ভাই রাশেদুল করিম, মাহবুবুল করিম, জেড করিম জিয়া টেকনাফের সাংবাদিক! সাইফুলের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ মনির টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর। তিনিও সাংবাদিক । অভিযোগ আছে, তারা সাংবাদিক পরিচয়ে সাইফুল করিমের ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে যাতে সাইফুল করিমের নাম প্রকাশ না হয় এবং স্থানীয় প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করতে সাইফুল করিম ভাইদের সাংবাদিক বানিয়েছিলেন!’ তাদের মাধ্যমে কিছু সাংবাদিকে ম্যানেজ করতেন। তিন সাংবাদিক দাবি করেছেন সাইফুল করিমের সঙ্গে কোন ধরনের সর্ম্পক ছিল না। একটি মহল বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। চলবে
পড়ুন আগের পর্ব:
টেকনাফের ৮০ শতাংশ মানুষ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত! পর্ব-৪
টেকনাফের অর্ধশত রুটে আসে ইয়াবা!- পর্ব- ৩
মডেল-নায়িকা-শিল্পী ও শিক্ষার্থীরা কেন সেবন করে ইয়াবা? পর্ব-২
‘ইয়াবা’ কেন জনপ্রিয় মাদক? পর্ব-১
বিএনএনিউজ, এসজিএন