।। বাবর মুনাফ ।।
জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতি আংগুল তুলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলে আসলেও, এই সংস্কার কর্মসূচী কবে শেষ হতে পারে সেই বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। ঘোষণা করেনি নির্বাচনী রোড ম্যাপ। ফলে বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয় ড. ইউনূস সরকারের। যদিও সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে চায় জামায়াতে ইসলামী। আর এই যৌক্তিক সময়ের আড়ালে রয়েছে জামায়াতের ঘর ঘোছানো এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে নিজেদের পছন্দের লোক বসানোর পরিকল্পনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই যৌক্তিক সময়ের ওপর নির্ভর করে ‘আনলিমিটেড স্পেস’ নিতে চায়! এর ফাঁকে নিজেরাই একটি তারুণ্যনির্ভর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে সংগঠন গোছাচ্ছে তারা। এখন চলছে থানা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ। জাতীয় নাগরিক কমিটির পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সাংগঠনিক কাজে তৎপর হয়েছে। তারাও জেলা পর্যায়ে কমিটি দেওয়া শুরু করেছে।
প্রতিনিধি কমিটির সদস্যদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষক, আইনজীবী, লেখক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী থেকে গৃহিণীরা রয়েছেন এসব কমিটিতে। তরুণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে কমিটিগুলো করা হচ্ছে। এই কমিটিগুলো ৬০ দিনের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটিতে রূপান্তরিত হবে।
কমিটি গঠনের পাশাপাশি দুটি সংগঠনের নেতারা জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় নিয়মিত বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। পাশাপাশি সংগঠন দুটির প্রতিনিধিরা বিভিন্ন জেলা সফর করছেন। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি বিভিন্ন জেলায় মতবিনিময় করছে। পাশাপাশি দুই সংগঠনই নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামো ইতিমধ্যে পুনর্গঠন করেছে। দুটি সংগঠনের কার্যক্রম এখন পরিচালিত হচ্ছে রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারের পৃথক কার্যালয় থেকে।
জাতীয় নাগরিক কমিটিতে দুই দফায় সদস্য বেড়ে এখন ১০৭ জনে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ ডিসেম্বর সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করে আটজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক, আটজনকে যুগ্ম সদস্যসচিব, পাঁচজনকে সহমুখপাত্র, চারজনকে যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এবং ১৪ জনকে সংগঠক করা হয়। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলমকে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক মনোনীত করা হয়েছে। সারা দেশকে ২০টি জোনে ভাগ করে সংগঠকদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে নাগরিক কমিটি। জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য পদে ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠন ও বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সাবেক নেতারাও রয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ‘প্রতিনিধি কমিটি’ গঠনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক বিস্তৃতি শুরু হয় জাতীয় নাগরিক কমিটির। এখন পর্যন্ত দেশের ৬৭টি থানা ও উপজেলায় তারা প্রতিনিধি কমিটি করেছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ২১টি কমিটি করা হয়েছে। এই দুই প্ল্যাটফর্মের নেতাদের সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আরও দু-তিন মাস লাগতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দলের নামেও চমক থাকবে। দল ঘোষণার পরও একটি ‘সিভিল পলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বহাল থাকবে জাতীয় নাগরিক কমিটি। নতুন এই কিংস পার্টির আত্মপ্রকাশের ওপর নির্ভর করছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ!
প্রসঙ্গত, গত ২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটানো শুরু করে। এখন পর্যন্ত দেশের ১৭টি জেলা, ৩টি মহানগর, ১টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি করেছে তারা। কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন শুধু শিক্ষার্থীরা। একেক জেলায় কমিটির আকার একেক রকম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণকারি রাজনৈতিক দলগুলোর নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হলেও তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে তাদের কাউন্টার করার জন্য বৈষম্য বিরোধীছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন এই ‘পলিটিক্যাল পার্টি’ আরেকটি ‘কিংস পার্টি’ হচ্ছে কীনা তা সময় বলে দিবে, মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
বিএনএনিউজ/ শাম্মী