29 C
আবহাওয়া
১২:৪৮ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ১৫, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » আল্লাহর অলিদের কেন অনুসরণ করতে হবে? কোরআনে কী বলা হয়েছে?

আল্লাহর অলিদের কেন অনুসরণ করতে হবে? কোরআনে কী বলা হয়েছে?

বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির (রহ.)

।।সিরাজুল আরেফিন চৌধুরী।।

মুসলিম সমাজ আজ দ্বিধা বিভক্ত! নানা দল-মতের মধ্যে কোনটি অনুসরণ করবে সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন! সকলের সৃষ্টিকর্তা এক (আল্লাহ), কোরআন এক, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক হওয়া সত্বেও কেন এত মতবিরোধ? এই অবস্থায় কাকে অনুসরণ করলে সঠিক পথে চলা হবে? এই প্রশ্ন আজ সাধারণ মুসলমানের মধ্যে। এরকম কঠিন সময় আসবে তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে পূর্ব থেকে সতর্কবাণী দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এই বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। এই অবস্থায় সাধারণ মুসলমানের করণীয় কী?

পবিত্র হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكْتُ فيكُمْ شَيْئَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُما كِتابَ الله وسُنَّتي وَلَنْ يَتَفَرَّقا حَتَّى يَرِدا عَلَيَّ الحَوْضَ


আবূ হুরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং আমার সুন্নাহ। ’হওয’ (কাওসারে) আমার নিকট অবতরণ না করা পর্যন্ত তা বিচ্ছিন্ন হবে না।- এই হাদিস শরীফ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় পবিত্র কোরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-র সুন্নাহ আকড়ে ধরলে কঠিন অবস্থাতেও কোন মুসলমান পথভ্রষ্ট হবে না। সুবহানাল্লাহ!


এখন আমরা একটু পবিত্র কোরআনের দিকে দৃষ্টিপাত করি। পবিত্র কোরআনে সর্বপ্রথম সূরা, সুরা ফাতেহা। এটি কুরআনের সারসংক্ষেপ স্বরূপ। এরপরেই সূরা বাকারার প্রথমে আল্লাহ বলেন- ١- الم ◯
٢- ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ◯ অর্থাৎ ১. আলিফ-লাম-মীম ২. এটি সেই উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কিতাব এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য এটি পথ নির্দেশক। (আলিফ-লাম-মিম হরফে মুকাত্ তা আত- আল্লাহ পাকের বিশেষ সংকেত সূচক)। পবিত্র কোরআনের উপর কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি নিশ্চিতভাবে আল্লাহর নিকট থেকেই অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ শুরুতেই এটি বলে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন : বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানির (রহ.) ওফাত দিবসটি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে ‘ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম’ নামে পরিচিত।

এরপর আল্লাহ বলেন মুত্তাকিদের জন্যই এটি পথ প্রদর্শক। এখানে আল্লাহ হুদাল্লিন-নাছ, বা হুদাল্লিল-মুসলেমিন বলেন নাই বরং বলেছেন হুদাল্লিল-মুত্তাকিন শুধুমাত্র মুত্তাকিদের জন্যই এটি পথ প্রদর্শক।
এখন প্রশ্ন হলো মুত্তাকী বলতে কি বুঝায়? শাব্দিক অর্থে মুত্তাকী হলো আল্লাহ ভীরু অর্থাৎ আল্লাহকে যারা বিশ্বাস করে ও ভয় করে। মুত্তাকী হলো তাকওয়া অবলম্বনকারী। এখানে সুরা বাকারার পরবর্তী আয়াত সমূহে (আয়াত ৩-৫) আল্লাহ মুত্তাকির পরিচয় দিয়েছেন ।

এ ছাড়া পবিত্র কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় মহান আল্লাহ মুত্তাকিদের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা এখানে বুঝার সুবিধার্তে সংক্ষেপ অর্থ নিলাম-মুত্তাকী হলো তাকওয়া অবলম্বনকারী। তাকওয়া হলো আল্লাহ-ভীতি অর্থাৎ সকল কাজে আল্লাহ দেখছেন এবং এর জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে- অন্তরে এই বিশ্বাস রাখা।


তাকওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। যেমন আল্লাহ বলেন- এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শন সমূহকে সম্মান করে, নিশ্চয়ই তা হচ্ছে হৃদয়ের তাকওয়া (সূরা হাজ্জ, আয়াত ৩২)। আল্লাহর নিদর্শন গুলোর অন্যতম হচ্ছেন- আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ। যেমন- সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, আল্লাহর প্রিয় বান্দা তথা আল্লাহর আউলিয়া গণ। আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের সাথে সম্পর্কিত হয়ে অন্যান্য বস্তুও আল্লাহর নিদর্শনে পরিণত হয়। যেমন সাফা-মারওয়া পর্বত যা মা হাজেরা আলাইহিস সালাম এর সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে আল্লাহর নিদর্শনে পরিণত হয়েছে, যা পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে স্বীকৃত।


পবিত্র কোরআনে অন্যত্র আল্লাহ বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِين অর্থাৎ-হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর (তাকওয়া অবলম্বন কর) এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক (সূরা তাওবা, আয়াত- ১১৯)। এখানে আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো অর্থাৎ তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বন করো অর্থাৎ তোমরা সত্যবাদী, সাদেকীন বান্দাদের অনুসারী হও। এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষণীয়- মহান আল্লাহ প্রথমে তাকওয়া অবলম্বন করার বিষয় উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ সত্যবাদী বা সাদেকীন বান্দাগণের পরিচয় আল্লাহ দিচ্ছেন- তাঁরা তাকওয়া অবলম্বনকারী।


পূর্বেই বলা হয়েছে মহান আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তাকওয়া বানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সত্যবাদী, সাদেকীন বান্দা তথা আল্লাহর প্রিয় বান্দাগনের অনুসরণ করা। কারণ এটার সাথে সুরা ফাতেহার মধ্যে আল্লাহ সিরাতাল মুস্তাকিম বা সরল সঠিক পথের পরিচয় দিয়েছেন (সুরা ফাতেহা আয়াত ৫) এটার সাথে মিলে যায়। এই আয়াতে বলা হয়েছে- তাদের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করুন যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন।


আল্লাহর আউলিয়াগণ হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা, সাদেকীন বান্দা। কারণ আল্লাহ আউলিয়াগণের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। এটার নিশ্চয়তা আল্লাহ পবিত্র কোরআনে দিয়েছেন, যেমন আল্লাহ বলেন- ٦٢- أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّـهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ◯ অর্থাৎ জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহর অলিগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা দুঃখিতও হবে না (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৬২)।


সম্মানিত পাঠক, এখান থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর ঘোষণা পাই, যারা আল্লাহর আউলিয়া তারাই আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত, অনুগ্রহ প্রাপ্ত। তাঁরা-ই সিরাতাল মুস্তাকিম এর উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ এই আল্লাহর আউলিয়া গণ-ই সালেকিন তথা সত্যবাদী বান্দা। তাদের অনুসরণ করার জন্য আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা তাওবা, আয়াত- ১১৯)।


আল্লাহর অলিগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং সকল মহলে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হযরত মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১০৭৭-১১৬৬ খ্রী.)। তিনি বড় পীর নামে আমাদের দেশে পরিচিত। আজ (১১ই রবিউস সানি, ১৫ই অক্টোবর ২০২৪) তাঁর বার্ষিক ফাতেহা শরীফ। এটি ‘ফাতেহায়ে ইয়াজদহম’ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী আল্লাহর অলিগনের অনুসরণ ও বরকত হাসিলের জন্যই তাদের ফাতেহাখানি পালন করা হয়। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নামানুসারে কাদেরিয়া তরিকা প্রতিষ্ঠিত। ভারতীয় উপমহাদেশ, আরব বিশ্বসহ সমগ্র পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরিকার অসংখ্য অনুসারী রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে এটিই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত তরিকা হিসেবে স্বীকৃত।


বিশ্ব বিখ্যাত হাদিস বিশারদ, ইসলামী স্কলার মোল্লা আলী কারী হানাফি রাহিমাহুল্লাহু তাঁর ‘হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনী ও কারামত’ নামক গ্রন্থে তাঁকে (হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.) ইসলামের পুনঃ সঞ্জীবনকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনার অবতারণা করেছেন। ঘটনাটি এরকম- হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে কেউ প্রশ্ন করলেন, হুজুর আপনাকে ‘মুহিউদ্দিন’ ডাকা হয় কেন? তিনি উত্তরে বললেন ৫১১ হিজরীতে আমি খালি পায়ে বাগদাদের দিকে যাওয়ার পথে রুগ্ন, গায়ের রং বিকৃত, দুর্বল এক লোককে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম।


তিনি আমাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি তাঁর কাছে গেলে তিনি মাটি থেকে তাঁকে তোলার জন্য আমাকে বললেন। আমি তাঁর হাত ধরে তুলতেই তিনি সুস্থ হতে লাগলেন, শরীরের গড়ন, রং সুন্দর হয়ে সুস্থ-সবল হয়ে উঠলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন-আপনি কি আমাকে চিনেন? আমি বললাম ‘না’। তিনি বললেন, আমি হলাম দীন (ইসলাম) যাকে আপনি দেখছেন, আপনার প্রভাবে নাজুক অবস্থা থেকে আল্লাহ আমাকে নতুনভাবে জীবন দান করেছেন। আপনি মুহিউদ্দিন বা দীন সঞ্জীবিতকারী নামে অভিহিত হবেন। তারপর তিনি (হযরত আব্দুল কাদের জিলানী) বাগদাদের জামে মসজিদে গেলে মানুষ তাকে ‘মহিউদ্দিন’ সম্মোধন করতে লাগলেন।


পরবর্তীতে তিনি ‘মহিউদ্দিন’ উপাধিতে পরিচিত হলেন (মোল্লা আলী কারি হানাফি, ‘আব্দুল কাদের জিলানী রহ. জীবন ও কারামত’ অনু. মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন, সঞ্জরি পাবলিকেশন, ২০১০, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)।


উল্লেখ্য হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইসলাম অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যশত্রু দ্বারা দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসলমানদের মধ্যে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই সংকটময় মুহূর্তে সমুদ্র বক্ষে ডুবন্ত তরীর ন্যায় জর্জরিত ইসলামকে পুনঃজীবন দান করেছিলেন বড় পীর হযরত সৈয়দ মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।


তরিকা হল পথ বা রাস্তা। আল্লাহর অলিগণের অনুসৃত বা নির্দেশিত পথ-ই হলো তরিকা। কাদেরিয়া তরিকা ব্যতীত আরো অনেক প্রসিদ্ধ তরিকা রয়েছে। যেমন চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, ওয়াইসিয়া ইত্যাদি। তরিকা সমূহের মধ্যে ইসলামের মৌলিক বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই। অনুসৃত পথ বা পদ্ধতির মধ্যে কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে, যেমন: জিকির পদ্ধতি, রিয়াজত বা সাধনা ইত্যাদি। তবে সকলের গন্তব্য এক, তা হল- আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়া।

সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী
সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী01



লেখক: সহকারী অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)

Loading


শিরোনাম বিএনএ