বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভাণ্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে।
আজ প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭১
যুদ্ধ কিভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা দু’-পাঁচজন মুক্তিসেনার সঙ্গে আলাপ করলেই জানা যায়। যারা আহত হয় তাদের কারোর হাতে বা পায়ে, কিংবা কাঁদে বা শরীরের অন্য কোথাও হয়তো গুলি লাগে। এগুলো যেন কাউকে বলার মতো কোন ব্যাপার নয়। নিতান্ত জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যায়: গুলি? তা লেগেছিল গোটা দুই হাতে কিংবা পায়ে বা অন্য কোথাও। বেশ কিছু ছেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কিন্তু তাদের কাছে তা বিশেষ কোন ব্যাপার নয়, জীবনে আর পাঁচটা ঘটনা প্রত্যেকদিন ঘটে, ঘটেছে; এও তেমনি। সেজন্য এসব ব্যাপারে কোন মুক্তিসেনার ভ্রুক্ষেপও নেই। তাদের সবার সামনে একটি মাত্র লক্ষ্য- শত্রু ধ্বংস করা।
দুটি তরুণের কথা শুনলাম। কয়েকবার যুদ্ধ করেছে এমন একটি ছেলের নাম খোকন। স্কুলের ছাত্র। হালকা গড়ন। লাজুক লাজুক ভাব। সবার সঙ্গে বিনয়ী ভাবে কথা বলতো। যুদ্ধ করতে করতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে কোন সুযোগ এলেই সে লাফিয়ে উঠতো। তার সঙ্গে শেষবারের মতো যখন আমার দেখা হয় তখন সে আমাকে বারবার বলেছিল, ‘আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য শত্রু খতম করে এদেশের শোষিত মানুষকে সত্যিকার স্বাধীনতা দেওয়া। কেউ যেন আর কোনদিন আমাদের বঞ্চিত পদদলিত করতে না পারে সে জন্যই আমরা জীবন দিচ্ছি। পাক-সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল খোকন। একটি সজনে গাছের আড়ালে লুকিয়ে গুলি চালাচ্ছিল সে। তার শেষ চেষ্টা ছিল সঙ্গীদের বাঁচানো। কয়েকজন খানসেনাকে খতম করার পর একটি গুলি সজনে গাছ ভেদ করে তার শরীর বিদ্ধ করে। মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে তার উত্তর ছিল একজন খানসেনার উদ্দেশ্যে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয়া। তাতেই খানরা তাদের বহু সঙ্গীকে হারিয়ে পালিয়ে যায়।
কাছাকাছি একটি শিবিরে দেখা হয় হাবলুর সঙ্গে। তার বুকে পাশ থেকে এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে। বাঁ হাতেও লাগে কয়েকটি গুলি, বাঁ পা-ও রেহাই পায়নি। ডান হাত ছাড়া হাবলুর আর কোন অঙ্গই চালু ছিলনা । বুক ও পেটের সামনের চামড়া মাংস সমেত উড়ে চলে যায়, হাত-পা অচল তবু হাবলু যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এক হাতে, ছুড়েছে গ্রেনেড। যে খানসেনাটি তাকে গুলি করেছিল তাকে হাবলু শেষ করেছে এক গ্রেনেডেই। সামনে যে কয়টি পড়েছিল তাদের কাউকেই ছাড়েনি সে। তারপর বুকে হেঁটে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সে নিরাপদ জায়গায় চলে। হাবলুর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো অচল হয়ে গেছে।
হাবলু বললো, ‘আমরা এখন খানদের একেবারে কাছে না পেলে আর গুলি ছুড়ি না। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে, আমরা হিসেব করে গুলি খরচ করি। ওরা বেহিসাবীর মতো মতো মরে, মরে অন্যায়ের ধ্বজাধারী হয়ে। আমরা মরি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, প্রতিটি প্রাণ আমাদের অমূল্য, একটি একটি মৃত্যু একটি অবদান।
এরকম বহু খোকন ও হাবলুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তারা সবাই প্রাণ দিচ্ছে, দিবে। তারা বারবার বলেছে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শোষণের শেষ ঘাঁটিটি পর্যন্ত ধ্বংস করতে চাই। কড়াই থেকে আগুনে পড়তে চাইনা আমরা। দশ লক্ষ নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মরছে প্রতিদিন হাজার হাজার। রক্ত দিচ্ছে মুক্তিসেনারা, দেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এর বিরাম নেই। কিন্তু তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেন মুছে যায়, শোষক যেন না গজায়, গরম কড়াই থেকে আমরা যেন আগুনে না পড়ি। তাহলেই, কেবল আমাদের জীবন বিসর্জন, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সার্থক হবে।(‘জাফর সাদেক’ ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৯৯) চলবে।
আগের পর্ব সমূহ :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৭০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬০
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা