21 C
আবহাওয়া
৯:৪২ অপরাহ্ণ - ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » বঙ্গবন্ধুর বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

বঙ্গবন্ধুর বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প

।।আর করিম চৌধুরী।। বিএনএ:    ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।তাকে খোকা বলে ডাকতেন পিতা শেখ লুৎফুর রহমান এবং মা সায়রা বেগম।ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।খেলার সাথীরা ডাকতেন ‘মুজিব’। বড় হওয়ার পর সহকর্মী বন্ধুরা ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’। মা-বাবার দেয়া পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান। সংক্ষেপে শেখ মুজিব বললেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এক অনন্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের হাস্যোজ্জ্বল প্রতিকৃতি।

শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী। সেইসঙ্গে কোমল হৃদয়েরও অধিকারী ছিলেন তিনি। তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, খোকা বড় হয়ে জননন্দিত রাজনীতিবিদ হবেন,সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত হবেন। কেউ কি বুঝতে পেরেছিলেন তার নেতৃত্বেই ধাপে ধাপে একদিন মুক্তিসংগ্রামের মোহনায় পৌঁছে এই ভূখণ্ড স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে; তিনিই হবেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি। গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল ও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়াশনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন।

১৮বছর বয়সে বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ২ মেয়ে – শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন ছেলে- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। অল্পবয়স থেকেই রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে তার। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্রসংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন তিনি। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন। এখানেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে রক্ষণশীল কট্টরপন্থী নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্তৃত্ব খর্ব করতে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তার নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ নেয়।

পঞ্চাশের দশক তার রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে দূরদর্শীতা এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেন তিনি। সে সময় মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি মন্ত্রী হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৬৩ সালে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্বের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা। ৬ দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভিত হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার জনগণ। জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে এক পর্যায়ে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শোষকগোষ্ঠী।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানেই উত্থাপিত হয় এগার দফা দাবি যার মধ্যে ছয় দফার সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিল।

আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধু তখনই বুঝে যান, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন।রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃংখল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। … প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়েতোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙ্গালি জাতির এই জাগরণে ভীত ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, নিষিদ্ধ করেন আওয়ামী লীগকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এরপর আসে ২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাতের অন্ধকারে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা; শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি হায়েনাদের নারকীয়তা থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে কোলের শিশু- কেউই রক্ষা পায়নি। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য তার আগেই, পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান শুরু হলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক আন্দোলনে সামিল হতে আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ সরকারের অধীনেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার পালা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে জাপিয়ে পড়েন বীর বাঙালি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় মাতৃভূমি, স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনককে বরণ করতে লাখো মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে। দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানান বঙ্গবন্ধু এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাহায্য আসতে শুরু করে। শুরু হয় বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এক নতুন যুদ্ধ।

আর এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ইন্ধনে রাজনৈতিক অস্থিতশীলতা সৃষ্টি করতে উঠে পড়ে লাগে এই চক্রটি। সে সময় বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৭৪ সালে সকল রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নীচে আনতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা ‘বাকশাল’। সেইসঙ্গে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রথম যে দলটি নিষিদ্ধ করা হয় তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের দল। এর ফলে দেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে। সমস্ত দেশ যখন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিখ তখনই আসে আরেকটি আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। সদ্য স্বাধীনজাতির জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড, তৈরি করে রাজনৈতিক শূণ্যতা, ব্যহত হয় গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারা। বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। অবহেলিত জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ও বাংলাকে একদিন সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তি, পরিবার কিংবা দলের সম্পদ নন। তিনি গোটা জাতির অহংকার।

 

আরও পড়ুন :  ১৫ আগস্ট বিষয়ক বিশেষ সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুকে নয়- হত্যা করা হয়েছে বাঙ্গালী জাতিকে!

 

বিএনএনিউজ,এসজিএন

Loading


শিরোনাম বিএনএ