বিএনএ, ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের সকল অর্জনের মূলে থাকা ‘জয় বাংলা’কে তাঁর সরকার জাতীয় স্লোগান ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছে যে, বাঙালি মাথা নিচু করে নয় বরং মাথা উঁচু করেই চলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার(১৪মার্চ) রাতে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দীপক শ্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘জয় বাংলা উৎসব’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বনানীস্থ হোটেল শেরাটনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই জয় বাংলা স্লোগানটা আজ সকলের হয়েছে এবং এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে আমরা এটাই বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই- আমরা বিজয়ী জাতি, আমরা বিজয় অর্জন করেছি, মাথা নত করে আমরা চলিনা, মাথা নত করে চলবোনা, বিশ্ব দরবারে বাঙালি মাথা উঁচু করেই চলবে।’
তিনি বলেন, জয় বাংলা শ্লোগান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান । জয় বাংলা শ্লোগান মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান আত্মত্যাগের শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান আমাদের অর্জনের শ্লোগান। যে শ্লোগানের মধ্যদিয়েই আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যে মানুষগুলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল।
তিনি বলেন, জাতির পিতা যখন ৬ দফা দিলেন ঠিক তাঁর আগেই ছাত্রলীগকে এই জয়বাংলা স্লোগানটাকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর অন্তর্নিহিত অর্থ একটাই ছিল- সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মানুষের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাটাকে জাগ্রত করা এবং এই স্লোগানের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন। যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ জাতির পিতা নিয়েছিলেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে।
আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাহাত্ম তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ৭ মার্চের যে ভাষণ, সেই ভাষণও তিনি শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। অর্থাৎ বাঙালির যে বিজয় হবে সে সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবিলা করতো এই জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। এই স্লোগান প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করতো।
প্রজ্ঞাপন জারির ১৫ দিনেও চর্চা নেই জয়বাংলা স্লোগানের
এদিকে ২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ২ মার্চ ২০২২ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলোও স্পষ্ট করেছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, সাংবিধানিক পদধারী সব ব্যক্তি, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে জয় বাংলা বলবেন৷
এছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে কোনো ধরনের সভা-সেমিনার শেষে জয় বাংলা বলতে হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণকারীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে৷ আর যে কোনো ধরনের অ্যাসেম্বলি, অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি যে ব্যক্তিই থাকবেন, তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেবেন৷
মন্ত্রিপরিষদের সভায় এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ তবে জয় বাংলা স্লোগান বাস্তবায়নে প্রজ্ঞাপন জারির প্রায় দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এর প্রতিফলন তেমন চোখে পড়েনি। কোথাও বা সীমিত আকারে পালন করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন : ২৫ মার্চ রাতে সারাদেশে ১ মিনিট ব্ল্যাকআউট
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের অপারগতা সামনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সির (বিএনএ) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জয় বাংলা স্লোগান বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক।
জয় বাংলা স্লোগানের বিষয়ে খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্টার মিজানুর রহমান সেলিম বলেন- জয় বাংলা স্লোগানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ববানদের বলা হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরাও অবগত আছে। তবে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় জয়বাংলা স্লোগান দেওয়া যায়নি।
গত ৭ মার্চ ক্যাম্পাসে সামান্য কিছু আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের উপস্থিতি ছিল সামান্য। আগামীতে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় শিক্ষকরাও জয় বাংলা স্লোগান দিবেন।
জয় বাংলা স্লোগান বাস্তবায়নের বিষয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষাকর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) গোলাম মাহবুব বলেন– করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরোদমে ক্লাস শুরু করা যায়নি। সভা- সমাবেশ সীমিত করার নির্দেশনা রয়েছে। আগামী ১৫ তারিখ থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হবে। ওই দিন আমরা উপজেলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে একটি মিটিং করবো।পরবর্তীতে কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জয় বাংলা স্লোগান বাস্তবায়ন করা যায় তার পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো।
তিনি আরও বলেন– সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর আমাদের তেমন কোন অনুষ্ঠান হয়নি, তাই আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিতে পারিনি।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে– করোনা পরবর্তী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত আকারে পরিচালিত হচ্ছে। পুরোদমে শিক্ষার্থী গণজমায়েত শুরু হয়নি। কোথাও আবার ক্লাস পরীক্ষা চালু থাকলেও অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। জাতীয় দিবস পালনেও রয়েছে সীমিত আয়োজন।
রাজধানীর পল্লবী ডিগ্রি কলেজের সহকারী শিক্ষক নাসিমা আক্তার (ছদ্মনাম)– তিনি জানান কলেজের কোন অনুষ্ঠানে এখনো জয় বাংলা স্লোগান শুরু হয়নি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে জয় বাংলা স্লোগান বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জয় বাংলা স্লোগানের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে একই নির্দেশনা। আইন শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানেরও রয়েছে একই বিধান। এরই ধারাবাহিকতায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানেও দিতে হবে জয় বাংলা স্লোগান।
এ বিষয়ে রাজশাহীর তানোর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এসআই) জসিম মিয়া জানান, জয় বাংলা স্লোগান দিতে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করার বিষয়টি তিনি জানেন। তবে থানায় এ নিয়ে কোন কার্যক্রম হয়নি। থানা কম্পাউন্ডে সকালে পতাকা উত্তোলনের সময়ও জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া হয় না।
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সলিমুল্লাহ বলেন, আমরা সবাইকে সোনার বাংলার শেষে জাতীয় স্লোগান জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শিখাচ্ছি।
জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের প্রফেসর তানভীর বলেন, আমরা আমাদের কলেজে ভর্তি ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থীদের জাতীয় স্লোগান জয় বাংলা বাধ্যতামূলক শেখানোর চেষ্টা করছি এবং ছেলেমেয়েরা এই শ্লোগানকে ধারণ করছে।
জানতে চাইলে আজিমপুর অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক দিলরুবা ইয়াসমীন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে এটা আমরা চালু করছি।
আজিমপুর গার্লস স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, আমরা অ্যাসেম্বলিতে আমাদের মেয়েদের জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান বলতে বলেছি এবং সেটি চালু হয়েছে।
উল্লেখ্য, জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার জন্য ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন আইনজীবী বশির আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে কোনো শাস্তির কথা বলা না হলেও এটা যারা লঙ্ঘন করবেন তারা আদালত অবমাননা করবেন৷ তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা যাবে৷
কারণ, এই সিদ্ধান্ত আদালতের৷ সরকার যদি সংসদে আইন পাস করে এটা করতো তাহলে কেউ কেউ বলতো তারা দলীয় স্বার্থে করেছে৷ কিন্তু এটা আদালতের নির্দেশে করা হয়েছে৷ জয় বাংলা স্লোগান কোনো দলের নয়, এটা সবার৷’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দীর্ঘদিন টেলিভিশন, রেডিও ও পত্রিকায় জয় বাংলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ বইয়ে লেখা যেতো না৷ বঙ্গবন্ধু শব্দটিও লেখা যেতো না, বলা যেতো না৷ লেখা হতো শেখ মুজিব৷
আরও পড়ুন : সেই নারী নবজাতকসহ আর বেঁচে নেই
বিএনএনিউজ২৪, এমএইচ, জিএন