ঢাকা: নতুন নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে যে, তাদের বেশিরভাগই সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, বেশি সুবিধা ভোগী ছিলেন। এই নতুন ডিসিদের মধ্যে অনেকেই শেখ হাসিনার সাবেক মন্ত্রী এবং সরকারের আস্থাভাজন দলীয় সচিবদের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। আবার কেউ কেউ একে অপরের আত্মীয় স্বজন। দলবাজ।
অভিযোগকারীরা সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। তারা বিশেষ করে প্রাক্তন কর্মকর্তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত দক্ষ, মেধাবী ও সৎ ব্যক্তিদের ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত দুই দিনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৯ জন ডিসির নিয়োগ বাতিল করেছে এবং ৪ জন ডিসির জেলার বদলির আদেশ দিয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বুধবার(১১ সেপ্টেম্বর) নিজ দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, গণমাধ্যম এবং এজেন্সির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আমরা ৮ জন ডিসির নিয়োগ বাতিল করেছি। এর আগে মঙ্গলবার একজন ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। তারা কর্মস্থলে যোগদানের আগেই নিয়োগ বাতিল করা হলো। তাদের বিষয়ে নিয়োগ কমিটিতে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। আমাদের মধ্যে দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই।
বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি:
গত সাড়ে ১৫ বছরে বিভিন্ন পদে বঞ্চিত কর্মকর্তারা বুধবার সাংবাদিকদের কাছে তাদের দাবি জানান। তারা বলছেন, ডিসি নিয়োগে জারি করা দুটি প্রজ্ঞাপন আজকের (বুধবার) মধ্যে বাতিল করতে হবে। তাদের অভিযোগ, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই সদ্য বিদায়ী সরকারের সময় সচিব ও সিনিয়র সচিবদের একান্ত সচিব ছিলেন। এমনকি ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ব্যক্তিরাও ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব ব্যক্তির অনেকেই বিগত সরকারের সময় প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দলবাজিতে লিপ্ত ছিলেন এবং কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে।
এই পরিস্থিতির প্রমাণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত দুই দিনে ৯ জন ডিসির নিয়োগ বাতিল করেছে, যা তাদের দাবি সমর্থন করে। তারা মনে করেন, এসব নিয়োগ ত্রুটিযুক্ত ছিল এবং তাই পুনঃবিবেচনা করে বাতিল করতে হবে।
তারা আরও বলেন, বিগত সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সৎ, যোগ্য এবং মেধাবী, তাদের ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
নতুন নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের নিয়ে যত বিতর্ক
ঢাকার নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তানভীর আহমেদ, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি মোমিনুর রহমানের ভাগনে। তিনি সাবেক আইন সচিব আবু সালেহ মো. জহিরুল ইসলামের একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সহকারী একান্ত সচিব সাজ্জাদুল ইসলাম শাহিনের নিকটাত্মীয়। বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা এবং জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের দেওয়া ডিসি ফিটলিস্টে তানভীর আহমেদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রাজশাহীর ডিসি মো. মাহবুবুর রহমান সাবেক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমানের ভাগনিজামাই। ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লাহ ঢাকার ডিসি তানভীর আহমেদের ভগ্নিপতি।
ময়মনসিংহের নতুন ডিসি মফিদুল আলম চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাসিরের পিএস হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কুষ্টিয়ার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ফারহানা ইসলাম সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে। তিনি একসময় রূপগঞ্জের ইউএনও ছিলেন এবং গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন গাজী টিভির সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ করেছেন।
ঝিনাইদহের ডিসি মো. আব্দুল আওয়াল, কমলনগর ও কুমিল্লায় ইউএনও হিসেবে কর্মরত থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন। তার নাম বিগত সরকারের ডিসি ফিটলিস্টে ছিল।
মাগুরার ডিসি মো. অহিদুল ইসলাম পাঁচ বছর মরিশাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারের ডিসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিনও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে এবং একটি মোটা বেতনে প্রকল্পে লিয়েন পোস্টিং নিয়েছেন।
নোয়াখালীর ডিসি খন্দকার ইসতিয়াক ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন এবং তার পিতা ও মামা গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। খুলনার ডিসি মো. সাইফুল ইসলাম ছাত্রলীগ নেতা বাহাদুর ব্যাপারির সহচর ছিলেন এবং হবিগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। গত সরকারের সময় তিনি কলকাতা হাইকমিশনে উপ-হাইকশিনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গোপালগঞ্জের ডিসি মো. কামরুজ্জামান বিগত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে সৌদি আরবে কনসাল জেনারেল পদে নিযুক্ত হন এবং রাজউকের পরিচালক ও হজ অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। সিরাজগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ মনির হোসেন রাজউকের পরিচালক হিসেবে পরিচিত এবং তার নাম শেয়ারবাজার কারসাজির অভিযোগে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
জামালপুরের ডিসি হাসিনা বেগম ঢাকা ডিসি অফিসে এলএও হিসেবে কাজ করেছেন এবং নরসিংদীতে ইউএনও হিসেবে থাকাকালে তাকে অনুপযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিশোরগঞ্জের ডিসি ফৌজিয়া খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত ছিলেন এবং জাহাঙ্গীর হোসেনের ডান হাত হিসেবে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।
শরীয়তপুরের ডিসি আব্দুল আজিজ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন এবং শেখ হাসিনার সরকারের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
পঞ্চগড়ের ডিসি মোহাম্মদ নায়িরুজ্জাম এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুম মুনিমের পিএস ছিলেন। লালমনিরহাটের ডিসি রকিব হায়দার উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বরগুনার ডিসি মোহাম্মদ শফিউল আলমের নাম বিগত সরকারের ডিসি ফিটলিস্টে ছিল। নীলফামারীর ডিসি শরীফা হক সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে জড়িত।
এছাড়া, নিয়োগ পাওয়া অন্যান্য ডিসিদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
এসজিএন