ইয়াবা। শব্দটি থাই। এর অর্থ ‘পাগলা ওষুধ’। এটি মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরী একটি মাদক। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে ইয়াবা খুবই জনপ্রিয় ! তরুন-তরুণীদের কাছে ইয়াবা ‘ক্রেজি মেডিসিন’ হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারে প্রস্তুতকৃত এ মাদকের ৯০ শতাংশ টেকনাফ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নতুন প্রজন্ম। সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে কঠোর অবস্থানে। তবুও কিছুতেই ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং দিনদিন গানিতিকহারে ইয়াবার আগ্রাসন বাড়ছে। কেন মরণ নেশা ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? কীভাবে, কোন রুটে ইয়াবা আসে? গন্তব্য কোথায়? কারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত? এসব জানতে দীর্ঘদিন সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর নির্বাহী সম্পাদক ইয়াসীন হীরা।
ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস) এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান)। এর মধ্য ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার। অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার৷ বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলার রয়েছে মাদকের রুট। এর মধ্য কক্সবাজার সবচেয়ে ভয়াবহ। প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা প্রবেশ করছে।
ইয়াবা তৈরী করা হয় ২৫-৩৫ মি: গ্রা: মেথামফেটামাইন ও ৪৫-৬৫ মি: গ্রা: ক্যাফেইন এর সংমিশ্রণে। কোনো কোনো সময় ১০-১৫% হেরোইন ও মিশিয়ে থাকে। ইয়াবা ট্যাবলেট আকারে ৬ মি:মি: ব্যাস একদিকে গোলাকার অপর দিকে চ্যাপটা আকর্ষনীয় রঙে তৈরী করা হয়। প্রতিটি গোলাপি ইয়াবার ওজন দশমিক ১০ গ্রাম। হলুদ ইয়াবার ওজন দশমিক ২০ গ্রাম।
জার্মান থেকে মিয়ানমার!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইয়াবা আবিষ্কার করা হয়। জার্মান প্রেসিডেন্ট অ্যাডলফ হিটলারের আদেশে জার্মান বিজ্ঞানীরা টানা পাঁচ মাসের চেষ্টায় ইয়াবা তৈরি করতে সক্ষম হন।যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনাদের ক্লান্তি দূর করে তাঁদের মধ্যে উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতেই হিটলার এ আদেশ দিয়েছিলেন। এই ট্যাবলেট টি মুলত হিটলার এর সময়ে নাৎসি সেনাদের বড়ি হিসেবে সেবন করান হত ,যেন যুদ্ধ চলাকালিন তারা ২৪ ঘন্টার অধিক সময়ে জেগে থাকতে পারে। কিন্তু ইদানীং ট্যাবলেট টি মাদক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইয়াবা ছাড়াও ২৪ ধরনের মাদক পাওয়া যায়। অন্য মাদকগুলো হচ্ছে, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন প্যাথেডিন, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন)। এর মধ্য সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইয়াবা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক ড. অরুপ রতন চৌধুরীর মতে, সহজে বহন, গ্রহণ ও দ্রুত অ্যাকশনের ফলে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে। এটা এতটাই সহজলভ্য হয়েছে যে, ঘরে-ঘরে, অলি-গলিতে ও মুদি দোকানেও পাওয়া যায়। আগে একটা সময় ঢাকা ও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এর ব্যবহার বেশি ছিল। কিন্তু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইয়াবা সেবনে কী ক্ষতি হয়?
ইয়াবা একসময় সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ক্ষুধা কমিয়ে দেওয়ার কারণে ইয়াবা ওজন কমানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ক্লান্তি কাটাতে অনেক শিক্ষার্থী, দীর্ঘ যাত্রার সময় গাড়িচালক এবং দৌড়বিদ ইয়াবা আসক্ত হয়ে থাকেন। একবার ইয়াবা আসক্তি হলে সহজে সহজে মুক্ত হওয়া যায় না। ধীরে ধীরে চোরাবালির মতো ডুবে যায় সেবনকারি, তার পরিবার, সমাজ। এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্রসহ শরীরের যে কোনো অঙ্গই আক্রান্ত হতে পারে। ধীরে ধীরে এটি অকেজো করে দেয় পুরো শরীর, মন ও মানসিকতা। হারিয়ে যায় যৌন ক্ষমতা। মস্তিষ্কের বিকৃতিও হতে পারে। অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনের পরিণিত নিশ্চিত মৃত্যু।
চলবে