27 C
আবহাওয়া
৪:১৪ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ২৩, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী ফকিরের কেরামতি!

রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী ফকিরের কেরামতি!

প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দীন!

বিএনএ, ঢাকা: মিনা আক্তার। বাংলাদেশ রেলওয়ের খালাসী। কর্মস্থল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামত কারখানার হুইলসপে। নিয়মিত বেতন-বোনাস, ওভারটাইম ও বিভিন্ন ভাতাও উত্তোলন করছেন। কিন্তু গত তিন বছরে একদিনও কর্মস্থলে যাননি। প্রতিদিন তার হাজিরা দেখানো হচ্ছে! কী করে সম্ভব? বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন কেরামতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দীন!

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে মিনা আক্তার (টি নং ৩৫০৯) রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ‘খালাসী’ পদে নিয়োগ পান। এর আগে থেকে রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার বাসায় ‘বুয়া’ হিসেবে কাজ করতেন। এখনো করেন! পার্থক্য, আগে বেতন দিতেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। এখন বেতন দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে!
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক-ডিএস (কারখানা) ফকির মো. মহিউদ্দিনের চট্টগ্রামের কদমতলী রেলওয়ে অফিসার্স কলোনীর বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে কাজ করতেন মিনা আক্তার। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। বাবার নাম কিতাব আলী।

২০১৯ সালে জুলাইয়ে মিনা আক্তারকে (রোল নং ৭৭৫ ) খালাসী পদে চাকরি পাইয়ে দেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। চাকরি হওয়ার পর কারখানার হুইলসপে মিনাকে পদায়ন করা হয়। ওই সময় হুইলসপের ইনচার্জ (এসএসএই) ছিলেন একেএম সাইদুর রশীদ। তিনি বর্তমানে অবসরে রয়েছেন।

বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) থেকে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্তি প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) হয়ে রাজশাহী রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলে যোগদেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। তখন চট্টগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে অফিসার্স কলোনীর বাসায় উঠেন তিনি। মিনাকেও নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। রাজশাহী ও ঢাকায় আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন তিনি। মাস ছয়েকের মধ্যে রাজশাহী রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চল থেকে প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) ডেট হয়ে তিনি রেলভবনে যোগদান করেন।

নথিপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই পূর্ব) হয়ে চট্টগ্রামের সিআরবিতে যোগদেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। সিএমই পূর্ব হয়ে যোগদানের পর ফকির মো. মহিউদ্দিন পরিবার নিয়ে আসেন চট্টগ্রামে। মিনাকেও সঙ্গে আনা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ঘুরে তার বাসায় কাজ করলেও দীর্ঘ সময় মিনার কর্মস্থল ছিল পাহাড়তলী ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার হুইলসপে।

২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যন্ত্র প্রকৌশলী (পূর্ব)’র পক্ষে যন্ত্র প্রকৌশলী (সদর) (পূর্ব) মো. জাহিদ হাসান স্বাক্ষরিত এক দপ্তরাদেশে মিনা আক্তারকে সিএমই পূর্ব দপ্তরে অর্থাৎ মহিউদ্দিন ফকিরের দপ্তরে আনা হয়। যার স্বারক নম্বর ৫৪.০১.১৫০০.১১০.০৫.০২০.১৯। বদলি আদেশে উল্লেখ করা হয়, প্রশাসনিক স্বার্থে অবিলম্বে কার্যকর হওয়ার নিমিত্তে মিনা আক্তারের প্রেষণাদেশ বাতিল করার পাশাপাশি সিএমই(পূর্ব) এর অনুমোদন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

২০২১ সালের ৭ য়েব্রুয়ারি মিনা আক্তারকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, সিএমই/পূর্ব মহোদয়ের দপ্তরাদেশ নং ৫৪.০১.১৫০০.১১০.০৫.০২০.১৯, তারিখ ০৪.০২.২০২১ খ্রি. মোতাবেক মিনা আক্তার, খালাসী, টি/নং ৩৫০৯, এসএসএই/ইনচার্জ/হুইলসপ, অধীন-কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ), পাহাড়তলী’কে অত্র দপ্তর হতে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। ছাড়পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে মিনা আক্তার কোন সিএল ছুটি ভোগ করেননি।

সিএমই পূর্ব থেকে পদোন্নতি পেয়ে সিএমই উন্নয়ন হয়ে ঢাকা রেলবভনে যোগদান করেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। তিনি যাওয়ার সময় মিনা আক্তারকেও ঢাকায় নিয়ে যান। মিনা আক্তারকে পুনরায় এক দপ্তরাদেশের মাধ্যমে একইভাবে পাহাড়তলী ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার হুইলসপে বদলি করা হয়। সেখানে বর্তমানে কর্মস্থল হলেও মিনা আক্তার রয়েছেন ফকির মো. মহিউদ্দিন ঢাকার শাহজাহানপুরের বাসায়।

মিনা আক্তার ঢাকায় অবস্থান করলেও চট্টগ্রামে রেলের নথিপত্রে প্রতিদিন উপস্থিত হয়ে কাজ করছেন! শুধু তাই নয়, তিনি রেলওয়ের কর্মের প্রতি এতটাই নিবেদিত যে, কখনো ছুটিও নেননি। পাহাড়তলী রেলওয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামত কারখানার হুইলসপের ইনচার্জ মো. ফরহাদ আহমেদ প্রতিদিন কর্মস্থলে তার হাজিরা দিচ্ছেন। ইনচার্জ রফিকুল ইসলামের নির্দেশনায় কারখানার প্রবেশমুখে টাইম অফিসের সময় রক্ষক মো. মহসিন টিকেট না লাগিয়ে প্রতিদিন তার হাজিরা নিশ্চিত করেন।

উল্লেখ, পাহাড়তলী ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার হুইলসপের কর্মচারির তালিকায় ৬৬ জনের নাম রয়েছেন। যার মধ্যে ৮ জন নারী কর্মচারি কাজ করেন। শুধু অনুপস্থিত থেকে বছরের পর বছর বেতন-বোনাস-ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন মিনা আক্তার। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মিনা আক্তার রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিনের শাহাজানপূরস্থ বাসায় বুয়া হিসাবে কর্মরত রয়েছেন!

সূত্র জানায়, জাহাজ-স্টিমার ও রেলওয়েসহ বিভিন্ন সেক্টরে সাধারণত খালাসী পদ রয়েছে। উপমহাদেশে রেলওয়েতে ব্রিটিশ আমল থেকেই খালাসী পদের কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির শ্রমিক-কর্মচারির পদ “খালাসী”। রেলের মাধ্যমে আসা মালামাল নামানো, ট্রেনের বগি ও ইঞ্জিন রুম পরিষ্কার, স্টেশন ও কারখানার ওয়াগানের সংস্কার করাই তাদের কাজ। সরকারি বেতন স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপে (২০তম গ্রেড) অবস্থান খালাসীর।

রেলওয়েতে মিনা আক্তারের সমসাময়িক খালাসী পদে চাকুরি করেন এমন একজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তিনি মাসে বেসিক ৯ হাজার ২ শত ৫০ টাকা, বাসা ভাড়া ৮ হাজার ৬৫ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫ শত টাকাসহ সর্বসাকুল্য ১৯ হাজার ৬৫ টাকা পান। দুই ঈদে ৯ হাজার ২ শত টাকা ঈদ বোনাস, ১ হাজার ৮০০ টাকা বৈশাখী ভাতাসহ অন্তত ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। সে হিসাবে কাগজে কলমে খালাসী মিনা আক্তার একদিনও কাজ না করে রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিনের সহায়তায় উল্লেখিত টাকা উত্তোলণ করে আত্মসাৎ করেছেন! তাকে আরও যারা সহায়তা করেছেন তারা হচ্ছেন, যন্ত্র প্রকৌশলী (সদর) (পূর্ব) মো. জাহিদ হাসান। পাহাড়তলী রেলওয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামত কারখানার হুইলশপের ইনচার্জ মো. ফরহাদ আহমেদ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, খালাসী মিনা আক্তার রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিনের বাসায় বুয়া হিসেবে কাজ করার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রেলওয়ের ডিএস/ডব্লিউ/পাহাড়তলী, ডব্লিউএম/সি/পাহাড়তলী, এএও/এম/পূর্ব/সিআরবি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবার জানা। বড় কর্তা বলে কথা! কেউ কর্তার বিরাগভাজন হতে চাননি। ফলে বছরের পর বছর এমন ‘অনিয়ম দুর্নীতি’ রেলওয়েতে ‘নিয়ম নীতিতে পরিণত হয়েছে!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু রেলওয়ের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিন নন, রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা খালাসীদের নিজের বাসায় কাজ করতে বাধ্য করেন। চাকুরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (উন্নয়ন) ফকির মো. মহিউদ্দিন এর বক্তব্য এবং রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (ডিজি) ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের মুঠোফোনে একধিকবার যোগাযোগ করা হলে কেউ কল রিসিভ করেননি।

বিএনএনিউজ২৪.কম/এনএএম/ওয়াইএইচ

Bnanews24 অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন

Loading


শিরোনাম বিএনএ