বিএনএ ডেস্ক: শ্রীলঙ্কা পর পাকিস্তানও নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। কমতে কমতে দেশটির বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ৯ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশটির রিজার্ভ গত বৃহস্পতিবার নেমেছে ৩০০ কোটি ডলারের নিচে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির কাছে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (এসবিপি) তার সাপ্তাহিক আপটেডে জানিয়েছে, গত ৩ ফেব্রুয়ারি সমাপ্ত হওয়া সপ্তাহে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে রিজার্ভ থেকে ১৭ কোটি ডলার কমেছে। এর ফলে রিজার্ভ এসে ঠেকেছে ২৯২ কোটি ডলারে।
বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার ফলে পাকিস্তানের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজের অর্থ পেতে ১০ দিন ধরে চলা আলোচনায় কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ।
পাকিস্তানের সঙ্গে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে আলোচনা শুরু করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল, যেটা শেষ হয় বৃহস্পতিবার। চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে আইএমএফের কাছে ৬৫০ কোটি (৬.৫ বিলিয়ন) ডলার অর্থ সহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। বৈঠকে আইএমএফের স্টাফ পর্যায়ে কোনো চুক্তি হয়নি, তবে দুই পক্ষই বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে, যেগুলো আর্থিক সহায়তা চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, কম রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কমে আসায় গত দেড় বছর ধরে পাকিস্তানের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির পর এই মুহূর্তে পাকিস্তানের রিজার্ভ সবচেয়ে কম। এখন যে রিজার্ভ আছে তাতে সবমিলিয়ে হয়তো ১৮ দিনের আমদানি ব্যয়ের খরচ মেটানো যাবে। স্থানীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আরিফ হাবিব লিমিটেডের (এএইচএল) গবেষক তাহির আব্বাস রয়টার্সকে বলেছেন, দেশের সংকট এড়াতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন অর্থপ্রবাহ এবং আইএমফের সহায়তা দরকার।
অর্থাভাবে বিদেশ থেকে আমদানি যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সে সময় বাজারে অনেক নিত্যপণ্য নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এর কারণ, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চাইছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা এই ধরনের কোনো নির্দেশ দেয়নি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট, আর সেই বিষয়টি কেবল একজন বলেননি, বহু ব্যবসায়ীই দিচ্ছেন একই তথ্য।
এ পরিস্থিতিতে গত ২ ফেব্রুয়ারি টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘আমরা অকল্পনীয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। আইএমএফের যেসব শর্ত, সেগুলো ধারণাতীত। তবে আমাদের শর্তগুলো মেনে নিতে হবে।’
রিজার্ভে নতুন অর্থ যোগ না হলে এই মজুত দিয়ে যে আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে তা সত্যিকার অর্থেই আশঙ্কাজনক। অবশ্য একটি দেশের আমদানির জন্য তিন মাসের রিজার্ভকে ধরা হয় নিরাপদ। রিজার্ভে প্রতিনিয়ত অর্থ যোগ হতে থাকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কারণে। পাকিস্তানে এই দুটি আয়েও দেখা দিয়েছে ভাটা।
বিপদের এই সময়ে রেমিট্যান্স গতি হারিয়েছে দেশটিতে। ব্যাংকিং চ্যানেলের বদলে হুন্ডিতেই অর্থ পাঠাচ্ছে প্রবাসীদের একটি বড় অংশ। কারণ, ব্যাংকের চেয়ে সেখানে দর পাওয়া যায় বেশি। খোলাবাজারে এক ডলারে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৭৫ রুপিতে। যদি আইএমএফ হাত বাড়িয়ে না দেয় এবং আরও কিছু সহায়তা না আসে, তাহলে শ্রীলঙ্কার পর দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তানও। চলতি বছরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে তাদের। কিন্তু রিজার্ভ যেভাবে কমছে, তাতে নিত্যপণ্য আমদানিতেই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা, সেখানে ঋণ পরিশোধ হবে বিলাসিতা।
দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। গত জুলাই-নভেম্বর অর্থবছরে পাকিস্তানে ৪৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫১ শতাংশ কম।
রিজার্ভে টানপড়েন কেন?
রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট কোনোভাবেই যেন পিছু ছাড়ছে না পাকিস্তানের। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে একই ধারা। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়তে পারে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য দেশটির মন্দ রাজনীতিক দায়ী বলে ওই বিশ্লেষণে বলা হয়।
বহুদিন ধরেই পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে অকার্যকর রাজ্য ব্যবস্থাপনা; যা গণতন্ত্র ও ঋণের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প মেয়াদি রাজনৈতিক পরিকল্পনা পাকিস্তানের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ পরিকল্পনা।
আগামী নির্বাচন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মাঝে রাজনৈতিক যুদ্ধ দেশটির সংকট আরো কঠিন করে তুলছে। তবে এসব কিছু বাদে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে পাকিস্তানের এখন জরুরিভিত্তিতে ঋণ প্রয়োজন।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে যে, তারা পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়ে অবগত। গত ১৯ জানুয়ারি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের প্রতি আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখছি৷
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকলাপে বোঝা যাচ্ছে তারা আইএমএফের বাইরে গিয়ে পাকিস্তানের জন্য বিশেষ কিছু করতে রাজি নয়। আইএমএফের পক্ষ থেকে ঋণ পেতে বিলম্ব হওয়ায় দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে গত বছর কৃষিপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে বন্যার ফলে গম উৎপাদন কম হওয়ায় দেশটি গম সংকটেও পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন। অর্থনৈতিক মন্দার ফলে দেশটিতে রুপির মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ কমতে কমতে ৩০০ কোটিতে ঠেকেছে; যা বিগত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এনএনিউজ২৪/ এমএইচ