বিএনএ, ঢাকা, বিশেষ প্রতিনিধি : কাওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার ‘খতমে বুখারী’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সোমবার কূটনৈতিক পাড়া বারিধারায় শোডাউন করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক।
তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়নগঞ্জ-৪ আসন থেকে ঐক্যফন্ট্রের প্রার্থী হিসাবে ধানের শীর্ষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। জামিয়া রহমানিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায় খতমে বুখারীর নামে শক্তি প্রর্দশনের শোডাউনে প্রধান অতিথি থাকবে হেফাজত ইসলামীর আমীর জুনায়েদ বাবু নগরী।
প্রসঙ্গতঃ ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রথম ‘খতমে বুখারী’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম আল্লামা আহমেদ শফি। এরপর দেশের অন্য মাদ্রাসা গুলো ‘খতমে বুখারী’ অনুষ্ঠান করতে থাকে। এটি বেদআত ও শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসাবে ঘোষণা দেয় কাওমীদের ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা তা পালন না করার ঘোষণা দেয়। দেশের অন্য মাদ্রাসা গুলোও তা মেনে নেয়।
উল্লেখ, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবু নগরীর নেতৃত্বাধীন অংশটির দখলে রয়েছে। ওই মাদ্রাসায় অনুষ্ঠানটি ‘বিদআত’ হিসাবে বন্ধ করা হলেও বারিধারার জামিয়া রহমানিয়া মাদানিয়া সেটি ‘জায়েজ’ হয় কীভাবে? এমন প্রশ্নে কওমী মাদ্রাসার আলেমদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক মুফতি মনির হোসেন কাসেমী সম্প্রতি দখলে নেয়া বারিধারা মাদ্রাসায় বিশাল পরিসরে ‘খতমে বুখারী’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বিশিষ্ট আলেমদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের। একই সঙ্গে বারিধারা মাদ্রাসায় তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি কূটনৈতিকদের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছেন। এতে কূটনৈতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে মাদ্রাসাটির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কাছাকাছি হওয়ায় নিরাপত্তার দিক দিয়ে মাদ্রাসাটি অত্যন্তস্পর্শকাতর। বারিধারা মাদ্রাসায় কোন ধরনের উগ্রপন্থী কার্যক্রম বহিঃবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেয়ার পাশাপাশি এদেশকে জঙ্গীবাদী বা উগ্রবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করার সুযোগ করে দিতে পারে।
সূত্র জানায়, বারিধারা মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদে যুদ্ধাপরাধী এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি থাকায় মাদ্রাসাটির রেজিস্ট্রেশন এর আগেই বাতিল করা হয়েছে। খতমে বুখারী অনুষ্ঠান পালনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ উপার্জন এবং সম্প্রতি, দখলকৃত বারিধারা মাদ্রাসাটিতে মনির হোসেন কাসেমীর অবস্থান সুদৃঢ় ও পাকাপোক্ত করা।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারবিরোধীদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বারিধারা মাদ্রাসা দখলে নিয়ে ভবিষ্যতে হেফাজতে ইসলাম ও সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই হবে মুফতি মুনীর ও তার সহযোগীদের মূল লক্ষ্য। মাদ্রাসা দখলে সরকারবিরোধী প্রভাবশালী আলেমরা মুফতি মুনীরের সকল ধরনের অপকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে জানা যায়।
বির্তকিত ‘খতমে বুখারী’ অনুষ্ঠানে আগত অতিথি জুনায়েদ বাবুনগরীসহ অন্যান্যদের ঢাল বানিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের উৎসবে নেমেছেন। এক্ষেত্রে জুনায়েদ বাবুনগরীর পাশাপাশি বারিধারা মাদ্রাসার স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা নুর হোসেন কাসেমীর পুত্র জাবের কাসেমীকেও ব্যবহার করে নুর হোসেন কাসেমীর দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনামকে ক্ষুন্ন করছে।
মাওলানা মাজহার আল কুরাইশী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সহীহ বুখারী শরীফের শেষ হাদিসটি যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাইরের আলেম দ্বারা পড়িয়ে শেষ করা হয়, তাই আমাদের দেশে ‘খতমে বুখারী’ নামে পরিচিত। প্রথাগতভাবে মাদ্রাসায় বুখারী শরীফ শেষ করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসাতে বহিরাগত আলেমদের দাওয়াত দিয়ে খতমে বুখারী নামক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। যিনি সারা বছর মেহনত করে পুরো বুখারী শরীফ পড়াতে পারেন তিনি কি শেষের একটি হাদিস পড়াতে পারবেন না? শেষের একটি হাদিস পড়ানোর জন্য ভাড়া করে শায়েখ আনার কথিত রেওয়াজটি মূলত নিয়মিত পুরো বুখারী শরীফের শিক্ষকের অধিকার হরণ ও এক প্রকার অপমানজনক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু না। বর্তমানে উক্ত অনুষ্ঠানটি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, এটি আসলেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নাকি টাকা আয়ের উৎস তা বোঝা মুশকিল।
বাংলাদেশের ক্বওমী মাদ্রাসাসমূহ উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের কারিকুলাম ও আচার অনুষ্ঠানগুলো অনুসরণ করে আসছে। দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম আল্লামা আবুল কাসেম নোমানী বলেছেন, বর্তমানে বিভিন্ন মাদরাসায় ‘খতমে বুখারি’র নামে যে মাত্রাতিরিক্ত প্রথা চালু হয়েছে তা শরিয়তের সংগে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ ক্বওমী মাদ্রাসা ও ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রতি বছরই খতমে বুখারী আয়োজন হলেও চলতি বছর হতে মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক খতমে বুখারী অনুষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদের সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহইয়া হাফিজাহুল্লাহ বলেছেন, মুফতিয়ে আজম মুফতি ফয়জুল্লাহ রহিমাহুল্লাহ সবসময় এ ধরণের খতমে বুখারিকে ‘বিদআত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং মানুষকে এ থেকে দূরে থাকতে আহ্বান করেছেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ২০০৮ সালের পর থেকে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় প্রচলিত এ খতমে বুখারি শুরু হয়। তবে এটি যেহেতু ইসলাম সমর্থন করে না তাই প্রচলিত ধারায় খতমে বুখারি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়,২০১০ এর ১৯ জানুয়ারিতে, এই সংগঠনটি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের নিয়ে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। এটি ২০১০ সালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে দেশ- বিদেশে আলোচনায় আসে। প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ শফির মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবু নগরীকে আমীর করে সম্মেলনের মাধমে ১৫১ সদস্যের কমিটি গঠন করে। সম্মেলন বর্জন করে আল্লামা আহমেদ শফির ছেলে আনাস মাদানীর নেতৃত্বাধীন গ্রুপ।
জুনায়েদ বাবু নগরী পাকিস্তানের ইসলামি ব্যক্তিত্ব ইউসুফ বিন্নুরীর শিষ্য। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা ও বিরোধীতা করে থাকেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধীতা করেন বক্তব্যে দিয়ে সারাদেশে অস্থিশীল পরিস্থিতি তৈরী করেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। তাকে সমর্থন দেন আমীর জুনায়েদ বাবু নগরী।
বিএনএনিউজ২৪/ওয়াইএইচ, এসজিএন