মাদারীপুর জেলার ডাসা উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আবদুর রহমান মীরের ছেলে সৈয়দ আবেদ আলী। ৮ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে সুদূর মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ফুটপাতে চট বিছিয়ে ঘুমানো, কুলির কাজ করা এই ব্যক্তি পরে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের গাড়ি চালকের চাকুরি নেন। চালাতেন চেয়ারম্যানের গাড়ি। আর সেখানে পেয়ে যান টাকার খনির সন্ধান। প্রশ্নপত্র বাণিজ্য করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন পিএসসির সাবেক গাড়ি চালক সৈয়দ আবেদ আলী। সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতেন। এলাকায় তিনি শিল্পপতি হিসাবে পরিচিত। আবেদ আলী শুধু শিল্পপতি নন, ধার্মিকও বটে। অকাতরে দান করেন। নামাজের সময় মসজিদ না পেলে পথে প্রান্তরে নামাজ আদায় করেন। তার ছবিও নিয়মিত ফেসবুকে আপলোড দেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন আবেদ আলী। সেঁটে ছিলেন পোস্টার। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কিন্তু দলীয় সমর্থন না পাওয়ায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। তিনি ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। বিদেশে এবং এরপর দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চড়েন বিলাস বহুল গাড়িতে। পিতা সৈয়দ আবেদ আলী এবং পুত্র সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম পিএসসি’র প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।
প্রবাদ আছে, সরিষায় ভূত! এই প্রবাদের সত্যতা মিলেছে দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। সনাক্ত করা হয়েছে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার একটি চক্রকে। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠতো সংঘবদ্ধ চক্রটি। খোদ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ৬ কর্মকর্তা কর্মচারি প্রশ্নপত্র ফাঁস বানিজ্যে জড়িত রয়েছে। এরা হলেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর, উপ-পরিচালক জাহাঙ্গির আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান।
কথায় বলে চোরের ১০ দিন গৃহস্থের একদিন। ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান। আরও আছেন সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম ও যুবক লিটন সরকার। রোববার ও সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম জানায়, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন উপপরিচালক মো. আবু জাফরের কাছ থেকে দুই কোটি টাকায় ক্রয় করেছেন। এর আগেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাংক খুলে তিনি প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো ফাঁস করেছেন। তার মধ্যে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও রয়েছে। এ কাজে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ নিতেন। গত ৫ জুলাই শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তাঁরা। চক্রেরা সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাঁদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাতনামা স্থানে রেখে ওই প্রশ্নপত্র ও তাঁর উত্তর দিয়ে দেন। এইভাবে অন্তত: ৫ শত পরীক্ষার্থীর কাছে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওই চক্রটি। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন খোদ পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন। দুই একদিনের মধ্য রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে মেধা যাচাইয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ হাসনা