২৬ আগস্ট, ১৯৭১
একটা খবরের মত খবর! করাচী থেকে এ-এফ-পি জানিয়েছে যে, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের প্রতি জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছে। যেসব সদস্য জঙ্গীশাহীর দৃষ্টিতে নিরপরাধ সুবোধ বালক, তাদের প্রতিই এই আবেদন জানানো হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মারফত সরকারী মহল গণপ্রতিনিধিদের সর্বপ্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
খবর শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাই না। মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছুরই সীমা আছে- সীমা নাই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নির্লজ্জ বেহায়াপনা, নিষ্ঠুরতা, ন্যাকামি আর ধোঁকাবাজির। আর সীমা নাই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ওদের নির্মম পেশাদারী রসিকতার। সম্ভবত: সে কারণেই, এতদিন পরে জঙ্গীশাহী গণপ্রতিনিধিদের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনের আবেদন জানাতে এতটুকু লজ্জাবোধ করেনি। কে না জানে, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যই তারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর এ জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলার মানুষ নি:শব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শিরদেশে পরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের নজিরবিহীন নির্বাচনী বিজয়ের গৌরবময় শিরোপা। বাংলার মানুষ বিগত নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং তার অনুসারীদের শুধু ভোটই দেয় নাই- দিয়েছিল হৃদয়ের অন্তহীন ঐশ্বর্যমণ্ডিত অবিচল বিশ্বাস, ভালবাসা আর আস্থা।
এ বিশ্বাস ও আস্থার যাতে এতটুকু অমর্যাদা না হয়, স্বীয় দায়িত্ব পালনে যাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয়, সেই সচেতন সতর্কতাই গণপ্রতিনিধিদের সমাবেশ ঘটিয়েছিল ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। দিনটা ছিল ৩রা জানুয়ারী, ১৯৭১ সাল। বাংলার উদার আকাশের নীচে শীতার্ত দিনের শেষ প্রহরে স্নিগ্ধ সূর্যালোক-স্নাত সুবিশাল রেসকোর্সের জনারণ্য আর উপরে জাগ্রত বিধাতাকে সাক্ষী রেখে সেদিন বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা শপথ নিয়েছিলেন। এক হাত বুকের উপর রেখে আর এক হাত ঊর্ধ্বে তুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গণপ্রতিনিধিরা বিবেকের নামেই ওয়াদা করেছিলেন: ‘জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা আমাদের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষা করবো- নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করবো আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব।’
এই শপথ যে ধোঁকাবাজির ভড়ং ছিল না, ছিল তাদের ঈমানেরই অঙ্গ- সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তার সুস্পষ্ট আভাস ছিল। শেখ মুজিব সেদিন বাংলার মানুষকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশ দিয়েছিলেন: যদি কেউ এই শপথ ভঙ্গ করে, যদি কোন গণপ্রতিনিধি তোমাদের বিশ্বাস ও আস্থার অমর্যাদা করে, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়- তাকে জ্যান্ত কবর দিও। এমনকি এই গাদ্দারি যদি আমি করি- আমাকেও তোমরা রেহাই দিও না।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ১১০) চলবে।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৮০
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা