বিএনএ, ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি নির্বাচনের দাবি করে আসছিলো। কিন্তু জামায়াত ইসলামী শুরু থেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের কথা বলে আসছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন।
কিন্ত বিএনপি’র ক্রমাগত চাপের মূখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান লন্ডনে গত ১৩ই জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকার সমর্থিত এনসিপি ও জামায়াত ইসলাম।
এই অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এগার মাসের মাথায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন, সংক্ষেপে পিআর নির্বাচন পদ্ধতি সামনে আনে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে একে অপরকে রাজনৈতিকভাবে ধরাশয়ী করতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো—নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে? এর সম্ভাবনা-সমস্যার জায়গা কোনগুলো? যে রাজনৈতিক দলগুলো এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে— তার কারণগুলোই বা কী কী?
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন’ পদ্ধতির নির্বাচনে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকেন না। ভোটাররা ভোট দেন দলীয় প্রতীকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ হবে।
খুব সহজবোধ্যভাবে বলতে গেলে, পিআর পদ্ধতিতে ১ শতাংশ ভোট যারা পাবে, তাদের থেকে শুরু হবে আসন বণ্টন। যেমন—বাংলাদেশের ৩০০ আসনের সংসদে ১ শতাংশ ভোট পাওয়া দল ৩টি আসন পাবে। ১০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৩০টি।
বিশ্বের ৯১টি দেশে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। এ অঞ্চলে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এ পদ্ধতি চালু রয়েছে। আবার অনেক জায়গায় এ দুটি পদ্ধতির মিশ্র ব্যবস্থাও চালু আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলনীতিতে এক হলেও একেক দেশের ‘পিআর’ একেক রকম। একটির সঙ্গে অন্যটির তেমন মিল নেই। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে যে পদ্ধতিটি চালু আছে তা পরিচিত ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নামে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২ টি নির্বাচন এই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ভোটের প্রচলিত পদ্ধতির সমালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, একজন হয়তো ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সিঙ্গেল মেজরিটি পেল। বাকি ৬৫ শতাংশ ভোট বিভিন্ন প্রার্থী পেল। তখন দেখা যাবে ৩৫ শতাংশের প্রতিনিধি শতভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে।
আবার পিআর পদ্ধতিতে যেহেতু ভোটাররা তাদের এলাকায় সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবেন না, সেহেতু দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনে এলাকাবাসীর স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে সেটি স্পস্ট নয়।
প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। যেখানে সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০, নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারা নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে।
আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০০টি। এখানে নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক অর্থাৎ প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর পদ্ধতিতে। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০০টি।
এই বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটির প্রধান বদিউল আলম তার মতামত তুলে ধরে বলেন ‘ভোটের প্রচলিত যে পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু আছে, তাতে কয়েকটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ও পরিবার এবং তাদের সমর্থিত কতগুলো ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটির প্রধান বদিউল আলমের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে একক সরকার গঠনের জন্য অন্তত ৫১ শতাংশ ভোট পেতে হবে। নয়তো অন্য দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে।
সেকারণে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং এর মিত্র কিছু দল সংসদীয় আসনে সরাসরি ভোটের বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
বিপরীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামন্থী ও বামপন্থী দল এবং সদ্যগঠিত এনসিপিও সংসদের দুই কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জোর দাবি জানিয়ে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পিআর পদ্ধতির পক্ষে অনড় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে জামায়াত ইসলামী, বিএনপিকে এককভাবে সরকার গঠন করা থেকে ঠেকাতে চায়!
পিআর পদ্ধতির অসুবিধার দিক হচ্ছে ‘এই পদ্ধতিতে দলগুলোর ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামী-স্ত্রী-আত্মীয়স্বজনকে মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ ভোটার তো পার্টিকে ভোট দেবে। ব্যক্তিকে ভোট দেবে না। আগে তালিকা দিলেও ভোটারের পছন্দ এখানে থাকবে না।’ এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিরুৎসাহিত হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মোট ভোটের আসন বিন্যাস নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কিনা তা ভেবে দেখতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া এই নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে দেশের রাজনীতিতে সবার অগোচরে আবার পরাজিত অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ, সুগম করে দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে বিপরীতে পিআর পদ্ধতি ছাড়া জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
কেন বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে পরস্পর বিপরীত অবস্থানে রয়েছে, আসুন এবার অঙ্ক কষি।
বিএনপি ২০১৮ সালে তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল ছয়টি আসন। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে তাদের আসন হতো ৩৯টি।
বর্তমানে সংবিধানে থাকা নির্বাচন পদ্ধতিতে বিএনপি ২০০১ সালে ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন জিতেছিল। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে ওই হারে ভোট পেলে এবার তাদের আসন হবে ১২৩টি। আবার ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩০টি আসন পাওয়া এ দল পিআর পদ্ধতিতে একই হারে ভোট পেলে আসন হতো ৯৬টি।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল ১২ শতাংশ, সেটাই তাদের দলীয় ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রাপ্ত ভোট। ওই সংসদে জামায়াত ইসলামীর আসন ছিল ১৮টি। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন হলে এবং আবারও দলীয় ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ ভোট পেলে জামায়াতের আসন দ্বিগুণ হয়ে ৩৬টিতে দাঁড়াবে। সুতরাং বিএনপি ও জামায়াত কেন পিআর পদ্ধতি নিয়ে দুই রকম অবস্থান নিয়েছে— তা বেশ স্পষ্ট।
দর্শক, অঙ্কের হিসাব এখনো শেষ হয়নি! ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ভোট পায় ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ। আসন পায় ১৯৩টি। বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ। আসন পায় ৬২টি। জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট ৭ দশমিক ২২ শতাংশ ভোট পায়। আসন পায় ১৪টি। অপরদিকে জামায়াত ইসলামী ভোট পায় ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। আসন পায় ১৪টি। অন্যান্য ছোটদল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পায় ৭দশমিক ১ শতাংশ। বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার অংশিদার হয় জামায়াত ইসলামী।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি ২০০১ সালে আসন পেত ১২৪টি। জামায়াত ইসলামীর আসন হতো ১২টি। দুই দল মিলেও সরকার গঠন করতে পারতো না!
অপরদিকে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো ১২০ টি। জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট আসন সংখ্যা হতো ২১টি। ছোট দল ও স্বতন্ত্র মিলে আসন পেতো ২১টি। সেই ক্ষেত্রে জাতীয় পাটি, কয়েকটি ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থনে আওয়ামী লীগ জাতীয় সরকার গঠন করতে পারতো!
পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে ক্ষমতাচ্যূত দলটি সংসদে বিপুল আসন নিয়ে ফিরে আসবে। এমনটাই মনে করেন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ইসলামী ও বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচন করবে। সেই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির ছোট দলগুলো মিলে মহাজোট গঠন করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং নির্বাচন সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হলে গনেশ উল্টেও যেতে পারে।
সবমিলিয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামী এবং এনসিপি কোন রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে?—এই মুর্হুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন?
সৈয়দ সাকিব