।।সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া।। রায় সাহেব বাজার থেকে সদরঘাটের দিকে একটু এগিয়ে গেলেই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিপরীতে তাকালেই দেখা যাবে জরাজীর্ণ ৯২ বছরের পুরোনো “আজাদ” সিনেমা হলটি। সেই পুরনো জৌলুস আর নেই।এখন আর এখানে সুচিত্রা-উত্তমের জুটি বাঁধা পোস্টার দেখা যায় না বা নায়ক রাজ রাজ্জাক-কবরীদের জুটির কোন বড় পোস্টার চোখে পড়ে না।কিংবা হালের সাকিব খান-অপু বিশ্বাসদের পোস্টারও চোখে পড়ে না। ‘বি-গ্রেড’ সিনেমা আর রুচিহীন কর্মকান্ডে সিনেমা হলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শকরা। বর্তমানে দর্শকদের জায়গা দখল করে নিয়েছে মাদকসেবী আর অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িতরা।
সিনেমা হলটি ঘুরে দেখা যায়, হলটির বেহাল দশা। হলের দেয়ালগুলো থেকে ইট, সিমেন্ট খসে পড়ছে। হলের উপরে টিনের চালা, ভারী বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায়। এছাড়াও দর্শকদের আকর্ষন করানোর জন্য আজাদ ম্যানশনের গা জুড়ে সব ‘বি গ্রেড’ এর চলচিত্রের পোস্টারে ছেয়ে আছে। যা সুস্থ সংস্কৃতির ও উন্নত মানসিকতা সম্পন্ন দর্শক টানতে সক্ষম নয়। ভিতরে গিয়ে দেখা যায় প্রায় দর্শক শূণ্য হলটি। আর সিনেমা ও দেখানো হচ্ছে কম্পিউটার আর পেনড্রাইভের মাধ্যমে।নেই আধুনিক কোন সিনেমা প্লেয়ার কিংবা এলইডি বাঙ্ক।
সিনেমা হলটি বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয়, আজাদ সিনেমা হলের ম্যানেজার পরিতোষ রায়ের সাথে।তিনি বলেন, দেশের চলচ্চিত্রের একসময় স্বর্ণ যুগ ছিল, তবে সেই স্বর্ণযুগ গত হয়েছে অনেক আগেই। আর নিম্নমানের গল্পের কারণেই দেশীয় চলচিত্রগুলো দর্শক হারিয়েছে। আর দর্শকদের চলচিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণেই মুখ থুবড়ে পড়ছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলো। তিনি আরও বলেন, আমাদের অবকাঠামোগত সমস্যা থাকার কারণে আমরা ভালো সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ পাইনা। বাংলাদেশ পিকচার এক্সিবিশন কেন্দ্র থেকে আমাদেরকে ভালো সিনেমা দেয়া হয়না। যার কারণে পুরাতন সিনেমাগুলো মোডিফাই করে এখানে প্রদর্শন করি। হলের নাজুক পরিবেশ হবার কারণে আমাদের এখানে রুচিসম্মত সিনেমার দর্শকও আসে না।
বি গ্রেড সিনেমার নোংরা ও অশ্লীল পোস্টারের বিষয়ে পরিতোষ রায় বলেন, এই পোস্টারগুলা সিনেমার ডিস্টিবিউটরদের করা। আমরা পোস্টারিং করি না। তারা যদি এই ধরনের পোস্টার প্রদান করে তাহলে আমাদের কি করার আছে। আমরা না করেছি এই ধরণের পোস্টার দেওয়ার জন্য।আমরা সিনেমার ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে কথা বলে পোস্টার পরিবর্তনের বিষয়টি সংশোধন করার চেষ্টা করবো। ভবনের তত্ত্বাবধানে থাকা সাদেকুর রহমান খোকনের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯২৯ সালের প্রথম দিকে মুড়াপাড়ার জমিদার মুকুল ব্যানার্জীর নামানুসারে প্রথম দিকে এর নাম ছিল “মুকুল টকিজ”।১৯৬৪ সালে বোম্বের শের আলী রামজি এ হলটি মুকুল বাবুর কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি নতুন নাম দেন আজাদ সিনেমা। ভবনটির নাম আজাদ ম্যানশন। ১৯৭৪ সালে ঢাকার এক চলচ্চিত্রপ্রেমী এ ইউ এম খলিলুর রহমান আজাদ সিনেমা হল কিনে নেন শের আলী রামজির কাছ থেকে। খলিলুর রহমানের মৃত্যুর পর এখন তাঁর চার ছেলে এই হলের মালিক।’
পুরান ঢাকার এক সময়কার নামকরা হলগুলোর মধ্যে “আজাদ” সিনেমা হল একটি। সে সময় ভালবাসার বোধকে মহিমান্বিত করা সুচিত্রা-উত্তমের ‘শিল্পী’ এবং ‘পথে হল দেরি’র মত কলকাতার বাংলা সিনেমা আজাদ সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল।পুরান ঢাকাবাসীর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই সিনেমা হলটি। ১৯২৯ সালে ঢাকায় নির্মিত হওয়া প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস এই হলে প্রদর্শিত হয়। ঢাকা শহরের রুচিশীল দর্শক থেকে শুরু করে সব ধরণের দর্শকে সরগরম থাকত আজাদ সিনেমা হল। ১৯৩০ সালে এই হলে দেখানো হয় চণ্ডীদাস, গোরা, ফেয়ারওয়েল টু আর্মস এর মত বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র।
পুরান ঢাকার সংস্কৃতি রক্ষা কমিটির সভাপতি শ্যামল বণিক বলেন,আজাদ সিনেমা হলে আমরা আশি-নব্বইয়ের দশকেও নিয়মিত সিনেমা দেখতে যেতাম।কত কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখেছি বন্ধুরা।নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে উৎসব লেগে যেতো পুরো পুরান ঢাকায়।কে কার আগে দেখবে।এখন আর সেই দিন নেই।আজাদ সিনেমা হল দেখলে কেমন জানি পুরোনো দিন গুলোর কথা মনে পড়ে।আমরা দীর্ঘ দিন থেকে সিনেমা হলটি সংস্কার করে পুনরায় আধুনিকায়ন করে চালু করার দাবি জানিয়ে আসছি।কয়েকবার মানববন্ধন করি ও স্মারক লিপিও দিয়েছি।বার বারই আশ্বাস পেয়েছি কিন্তু কোন কাজ হয়নি।হলটি দ্রুত সংস্কার করে পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ফের দাবি জানাচ্ছি।
বিএনএ নিউজ২৪/এসজিএন।