।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
বিএনএ, ঢাকা: ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের জন্ম হয়। তখন থেকে দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ছায়া নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান ছিল। পাকিস্তানের গণতন্ত্র কখনো সেনাবাহিনী নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, রাওফরমান আলী, জিয়াউল হকসহ বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তারাই পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সেনা নির্ভরতা থেকে যেই রাজনীতিবিদ বেরিয়ে এসেছে তাদের হয়ত জীবন দিতে হয়েছে, নয়তো কারাগারে গেছে। এমন কী সেনাবাহিনীর সঙ্গে রফা করে স্বেছায় নির্বাসনে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ইমরান খানের পতনের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন করে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা আলোচনায় এসেছে এবং তার বিদায়ের পেছনের শক্তি হিসাবে আঙুল উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনীর দিকে। তার ক্ষমতায় আসা এবং সরে যাওয়ার গল্প কিন্তু সেই সেনাবাহিনীরই সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ২৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানে এই নিয়ে একটানা তৃতীয়বার সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে। দেশটিতে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও নির্বাচন হয়নি, যা বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পেরেছে। পাকিস্তানে আগামী আটই ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সামরিক হস্তক্ষেপে।
বর্তমানে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এখন কারাগারে। আর ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন নির্বাসনে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। তিনি এখন দেশে ফিরে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা ৮ ফেব্রুয়ারির জন্য। এইদিন একটি কাগজে কলমে নির্বাচনের মাধ্যমে নওয়াজ শরীফই হতে যাচ্ছেন সেনা সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী।
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন পাকিস্তানের সামরিক গণতন্ত্রের এই নির্বাচন, নওয়াজ শরীফের এবং ক্ষমতায় ফিরে আসাকে ‘নতুন বোতলে পুরান মদ’ বলে অবহিত করেছেন। ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সীমান্ত ইরান এবং তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের লাগোয়া। আমেরিকা আর পাকিস্তানের সম্পর্ক ‘লাভ অ্যান্ড হেট’-এর। পাশাপাশি চীনেরও ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান।
ক্ষমতায় আসাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে গত বছর থেকেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সরিয়ে ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসে জোটের সরকার। এরপর গত বছর অনির্বাচিত ‘কেয়ারটেকার সরকার’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের তত্ত্বাবধানে গত নভেম্বরের মধ্যে দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যেতে থাকে।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নওয়াজ শরিফ। তবে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন না। সে সময় তিনি জেলে ছিলেন। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সে বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। শারীরিক সমস্যার কারণে ২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। নিজের দেশে ফিরে আসেন গত বছর। এর মাঝে, ২০২২ সালে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
নওয়াজ শরিফকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয় ২০২৪ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তার উপরে থাকা আজীবন নিষেধাজ্ঞাকেও অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়। পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন, নওয়াজ শরিফের চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় আসার পথটাকে প্রশস্ত করেছে ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান দূরত্ব।
২০১৩ সালে তৃতীয় মেয়াদের সময় থেকে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তুমুল টানাপোড়েন শুরু হয়। এবং নওয়াজ শরিফ ক্ষমতা থেকে সরে যান। ক্রিকেট দুনিয়া থেকে রাজনীতিতে আসা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ইমরান খান এখন কারাগারে। এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় তিনি কারাভোগ করছেন। ইমরান খান একা নয় তার স্ত্রীও দুটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। নির্বাচনে ওই দম্পতি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, পিটিআই নেতারা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এমন কী ক্রিকেট ব্যাটের নির্বাচনী প্রতীকও দলের হাত থেকে চলে গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সমালোচকরা তাকে ‘সামরিক বাহিনীর মুখোশধারী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি জেলে থাকাকালীন ইমরান খানের সমর্থকরা অভিযোগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কারাগারে থাকার পিছনে সেনাপ্রধানই দায়ী।
বিবিসি জানিয়েছে, গত নির্বাচনে তিন নম্বরে ছিল বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। তিনি দলটির চেয়ারম্যান। পাকিস্তানের মন্ত্রীও ছিলেন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারির ছেলে তিনি। ২০০৭ সালে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়। বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনে নেমেছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিগুণ বেতন, সরকারি ব্যয় কমানো, বাজেট বাড়ানো-সহ একাধিক বিষয়। তার দল এই নীতি বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট সরকার তৈরি হলে তিনিই ‘কিংমেকার’ হতে পারেন।
পাকিস্তানের রাজনীতি যারা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের মতে সেখানে বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু গত ছয় বছরের তুলনায় খুব একটা বদলায়নি। এবারও কয়েক ডজন প্রার্থীকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে জেলে আছেন অথবা বাধ্য হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন এমনই শক্তিশালী যে, যে কোন রাজনৈতিক দলই তাদের সাথে আপোষ না করে টিকে থাকতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এ পর্যন্ত দেশটির কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
বিএনএনিউজ/ বিএম/এইচমুন্নী