22 C
আবহাওয়া
১২:০৭ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ২২, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » বগুড়ায় আ.লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কোন্দল: ৯ বছরে ৫১ নেতা খুন!

বগুড়ায় আ.লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কোন্দল: ৯ বছরে ৫১ নেতা খুন!

খুনিরাই পেয়েছে দলীয় পুরস্কার!

বিএনএ, ঢাকা: বগুড়া বিএনপির ‘ঘাঁটি’ বলে পরিচিত। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বগুড়ায় বিএনপি নেতাদের আধিপত্য ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে একটু একটু করে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিএনপিকে আগের মতো ক্ষমতা প্রদর্শনে দেখা যায় না। তার স্থান দখল করেছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গ সংগঠনগুলো। পরিবহনে চাঁদাবাজি, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত হন আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মীরা। এতেই বেড়েছে খুন খারাবির ঘটনা।

বগুড়া জেলায় ১২টি উপজেলা। এর মধ্যে সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় রাজনৈতিক খুনোখুনি বেশি। আভ্যন্তরীণ সংঘাতে জেলায় খুন হওয়া ৫১ জনের মধ্যে ২৭ জনই এই দুই উপজেলার। স্থানীয় লোকজন বলছেন, বগুড়া সদর হলো ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবসার কেন্দ্র। সেখানে পরিবহনকেন্দ্রিক ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়। মাদক ব্যবসাও রয়েছে।

YouTube player

অন্যদিকে, শাজাহানপুর উপজেলাটি সদর উপজেলা লাগোয়া। শাজাহানপুরের একটি অংশ পড়েছে বগুড়া পৌরসভার মধ্যে। সেখানেও মাদক ব্যবসা, জমির ব্যবসা ও দখল, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে।

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ, দলটির সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের ৫৮ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন ৫১ জন। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রধান কারণ দলের পদ পাওয়া, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, দখল, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।

৫১ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১০, যুবলীগের ২৫, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৯ ও ছাত্রলীগের ৭ জন। আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক ও অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা বেশি যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এ কারণে এই দুই সংগঠনের নেতা–কর্মী খুনের সংখ্যা বেশি।

বগুড়া জেলায় সংগঠিত ৫১টি খুনের মামলায় শুধু একটির বিচার শেষ হয়েছে। সেটি হলো বগুড়া শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল আনাম প্রকাশ রেক্কাত হত্যার। মামলায় ১১ জন আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। এই হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল ২০১২ সালে।

বগুড়ায় দলের নেতা-কর্মীদের খুনের মামলার আসামিরা দল ও সহযোগী সংগঠনে পদ পেয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খানকে হত্যা করা হয়। মামলার অভিযোগপত্রের মূল আসামি সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফকে তখন ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তবে ২০২৩ সালে তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।

যুবলীগ নেতা মজনু ও তাঁর ভাগনে নাহিদ প্রামাণিককে খুনের মামলার আসামি করা হয়েছিল আসাদুর রহমানকে। তিনি এখন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের সদস্য।

খোদ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, খুনের মামলার আসামিদের দলের পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। কোনো কোনো মামলায় খুনের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়।

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে ‘দলবাজি ও পেশিশক্তি’ বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বগুড়ায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে কারা নিয়ন্ত্রক হবেন, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আগেও খুনোখুনি হয়েছে, সাম্প্রতিককালেও একই ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়া পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে শাজাহানপুর উপজেলার মধ্যে। এই ওয়ার্ডের ফুলতলায় বাড়ি, যুবলীগের দুই নেতা আমিনুর রহমান (শাহীন) ও মজনু প্রামাণিকের। আমিনুর খুন হন ২০১১ সালে। দুই বছর পর খুন হন মজনু। সেই থেকে আমিনুর ও মজনুর সাত স্বজন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আমিনুরের স্বজন তিনজন, মজনুর চারজন।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং আমিনুর ও মজনুর পরিবারের ১৩ স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমিনুর ছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ‘ক্যাডার’। ২০১৯ সালে মমতাজ উদ্দিন মারা যান। তার পর থেকে আমিনুরের পরিবারকে প্রশ্রয় দেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান (দুলু)। তিনি মজনু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। মজনু ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম (মোহন) এর ক্যাডার। তবে এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মন্জুরুল ইসলাম।

অবশ্য স্বজনেরাই বলছেন, নিহত আমিনুর ও মজনুকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এখনো তাঁদের স্বজনদের ব্যবহার করেন। তাই খুনোখুনি বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন হন আমিনুরের ভাগনে ফোরকান আলী, যিনি যুবলীগ কর্মী ছিলেন। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে মজনুর কয়েকজন স্বজনকে।

২০২০ সালে পরিবহনে ‘চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হন বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হানিফ। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় প্রধান আসামি করা হয় জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলহাজ্ব শেখকে। মামলার অভিযোগপত্র থেকে আলহাজ্ব শেখের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মামলার বাদি আদালতে নারাজি আবেদন করারও সাহস পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সহসম্পাদক নাজমুল হাসান (অরেঞ্জ), একই বছরের সেপ্টেম্বরে শেরপুর উপজেলায় পৌর আওয়ামী লীগ নেতা মর্তুজা কাওসার (অভি) এবং ২০২১ সালের জুলাইয়ে বগুড়া সদর উপজেলার ফাঁপোড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মমিনুল ইসলাম (রকি)কে হত্যা করা হয়।

বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহজালাল তালুকদার ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁকে ধাওয়া করে কয়েকজন সন্ত্রাসী। তিনি একপর্যায়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁকে কুপিয়ে খুন করা হয়।

এই খুনের মামলার প্রধান আসামি করা হয় সাগর তালুকদারকে। তিনি পদে না থাকলেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। অভিযোগ আছে, আশেকপুর ইউনিয়নে ‘সাগর বাহিনী’ নামে তাঁর একটি বাহিনীও আছে।

শাহজালালের ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০২০ সালে সাগর বাহিনীর হাতে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিন। শিহাব খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁকে একবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। একই কারণে তাঁর ভাই শাহজালালকে খুন করা হয়।

গত ১৩ জুন বগুড়া শহরে দুই তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মামলার এজাহার অনুযায়ী, সড়কে প্রাইভেটকার দাঁড় করানো নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিতণ্ডার জেরে দুই তরুণকে খুন করা হয়। এই ঘটনায় মামলার আসামি করা হয়েছে বগুড়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ (টিপু) এবং তাঁর ভাই ও জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠুকে।

বগুড়ায় ‘টার্গেট কিলিং’ বেশি বলে উল্লেখ করেন জেলা পুলিশ সুপার বর্তমানে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। আগে রাজনৈতিক কারণ, আধিপত্য বিস্তার, বালু ব্যবসা, হাটবাজারের ইজারার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটত। তবে গত দুই বছরে সেই সংখ্যা কমে এসেছে। এখন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে খুনোখুনির ঘটনা বেশি ঘটছে।

বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী 

Loading


শিরোনাম বিএনএ