বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খন্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভান্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। ওয়েব সাইট সার্ভার রক্ষনাবেক্ষণ জটিলতার কারণে কিছু দিন বন্ধ ছিল। আবারও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে যাচ্ছে। ১ মার্চ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেপথ্যে গণ মাধ্যমের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
আজ প্রকাশিত হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৬
অনুষ্টান শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে। আমাদের পরবর্তী অনুষ্টান বাংলা খবর।
স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার থেকে খবর বলছি। আমাদের বিপ্লবী গণবাহিনী শত্রুর দুর্ধর্ষ আক্রমণকে প্রতিহত করে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সামরিক ঘাঁটিতে এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। সামরিক বিধি-বিধান, ভয়-ভীতি সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমাদের বিপ্লবী বাঙালী সৈন্যবাহিনী শত্রুদের হটিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে বাংলার মাটি আজ দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম এবং আরও কয়েকটি জেলায় সামরিক ঘাঁটি আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে এসে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত মানবতার সহায়তা আমরা পাচ্ছি। খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের বীর সেনানীরা বিপুল বিক্রমে দুশমন সৈন্যকে প্রতিহত করে চলছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মুক্তির আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানার পুলিশ বাহিনী আমাদের সাথে লড়ছেন। ই-পি-আর বাহিনী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাংলার বীর স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার যুবক সম্প্রদায় প্রত্যেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আজকের মত খবর এখানে শেষ করছি। জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আমাদের বিশেষ অনুষ্ঠান আজকের মত এখানেই শেষ হলো। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা।
শক্রবাহিনী উপায়ান্তর না দেখে ট্যাঙ্ক ও মারাত্নক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে, আঘাত হানার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বাঙালীদের আয়ত্তে। (একজনের হাততালি ও বাহবা)কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম পৌছে গেছে। এদেশের অন্যান্য সকল স্থান বাঙালিদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীনে এসে গেছে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।
এখন খবর পড়ছি-
বাংলাদেশের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের প্রচন্ড লড়াই চলছে। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ জনতার সাহায্য নিয়ে আক্রমণের পর আক্রমণ করে চলেছে। ঢাকার সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনীর কর্মাধ্যক্ষ টিক্কা খান দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কিছুক্ষণ পূর্বে হানাদার সৈন্যদের মুখপত্র পাকিস্তান রেডিও থেকে যে খবর পৌছেছে যে শেখ মুজিব ধৃত হয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক। টিক্কা খান তার দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সম্পূর্ণভাবেই বাঙালিদের আয়ত্তাধীন। কুমিল্লা থেকে একদল সৈন্য চট্টগ্রামের পথে পালাবার সময় বাংলার বিপ্লবী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনী তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে ও তারা এখন তাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিভিন্ন অবস্থায় পালিয়ে রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু এক নির্দেশ জারি করেছেন যে পলায়িত সৈন্যরা যাতে কোনক্রমেই রেহাই না পেতে পারে। চট্টগ্রামের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে বাঙালি সৈন্যদের আয়ত্তাধীন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য বিভিন্ন অবস্থানে লুকিয়ে রয়েছে।চট্টগ্রামের বীর জনতা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ তাদের ধ্বংস করে দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রামের বিভিন্ন অবস্থান থেকে হানাদার বাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে করে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটা ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।যশোর, রংপুর, সিলেট এসব শহরেও এখন পর্যন্ত প্রচন্ড গোলাগুলি চলছে এবং হানাদার সৈন্যদের এখন মূল লক্ষ্যস্থল হলো বেতার কেন্দ্রগুলো। তারা বেতার কেন্দ্রগুলো দখল করে সেখান থেকে ভুয়া প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্ত বাংলার বীর জনতা তাতে মোটেই বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকার পথে পথে এখন মুক্তিসেনা এবং বেংগল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশদের সাথে হানাদার সৈন্যদের প্রচন্ড লড়াই চলছে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, টিক্কা খান তার দলবল সহ নিহত হয়েছেন।
সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যের নির্দেশ অমান্য করে জনসাধারণ স্বাধীন বাংলার পাহারাদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে চলছেন এবং তারা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত প্রত্যেকটি নির্দেশকে হুবহু মেনে চলছেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতিসংঘের কাছে এক আহবানে বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে তাই জাতিসংঘে এখন উচিত বিদেশী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটানোর ব্যাপারে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করা। আপনারা এ খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – পঞ্চম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৮-৯)
চলবে
পড়ুন আগের পর্ব :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-০১
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসিন হীরা