29 C
আবহাওয়া
১২:২১ পূর্বাহ্ণ - অক্টোবর ১, ২০২৫
Bnanews24.com
Home » ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল?

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল?

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল?

।। বাবর মুনাফ ।।

১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের ডাক দেয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ওইদিন মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে পল্টন, বায়তুল মোকাররম, দৈনিক বাংলার মোড় ও মতিঝিলে দফা দফায় হেফাজতে কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। অগ্নি সংযোগ, টিয়ার শেল ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

তারপরও হেফাজতে ইসলাম তাদের কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় এবং ১৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৩ দফার মধ্যে অন্যতম ছিল:

YouTube player

১। সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২। আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুত্সা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩। কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুত্সা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪। ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতত্পরতা বন্ধ করা।
৭। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতত্পরতা বন্ধ করা।

হেফাজতে ইসলাম যখন তাদের ১৩ দফা দাবি আদায়ে শাপলা চত্বরে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বলপ্রয়োগ করে উচ্ছেদ করার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় মধ্যরাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অন্ধকার রাতে ঝটিকা অভিযান চালায় র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি’র ১৫ থেকে ২০ হাজার সদস্য। দৈনিক বাংলা ও ফকিরাপুল মোড়সহ তিন দিক থেকে অপারেশন শুরু করা হয়।

একযোগে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে অসংখ্য গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে নৃশংস, বর্বর ও ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা চালানো হয় হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের উপর। তখন ইত্তেফাক মোড় ঘিরে রাখে র‌্যাবের শত শত সদস্য। অভিযানের সময় সশস্ত্র অপারেশনের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা।

রাত আড়াইটা থেকে শুরু হওয়া এই যৌথ অভিযানে ১০ মিনিটের মধ্যেই হেফাজতে ইসলাম এর কয়েক লক্ষ নেতা-কর্মীকে মতিঝিল থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তারা যাত্রাবাড়ি ও ডেমরার দিকে চলে যায়। ঝটিকা অভিযানে শত শত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী হতাহত হয়।

পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে পুরো অভিযান পর্যবেক্ষণ করেন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। নৃশংস এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন র‌্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল হাসান, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মারুফ হাসান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অর্থ) আব্দুল জলিল মন্ডল। অভিযানের সময় আমর্ড পার্সোনাল কেরিয়ার থেকেও শত শত রাউন্ড গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।

ওই দিন রাজধানীজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা হয়। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ৭ জেলায় হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে সহিংসতা ঘটে। ওই সময় সরকারি হিসাব অনুযায়ী পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মোট ১৯ জন নিহত হন।

তবে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, শাপলা চত্বরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় হেফাজতে ইসলামের ৬১ জন নিহত হন। ওই সময় অধিকার এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগ সরকার অধিকারের তৎকালীন সেক্রেটারি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং সংগঠনের বর্তমান পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে।

শাপলা চত্বরের ওই ঘটনার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকাসহ ৭ টি জেলায় হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ৫৩ টি মামলা দায়ের করে। এই ৫৩ টি মামলার মধ্যে ৪৯ টি মামলার এখনও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

অপরদিকে, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব ঘটনায় সারাদেশে ২২১টি মামলা দায়ের করা হয়। সব মিলিয়ে হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় ২৭০ টি মামলা এখনও রয়েছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারাবন্দী হেফাজত নেতা-কর্মীদের বেশিরভাগই জামিনে মুক্তি পান। বেশ কয়েকজন এখনও কারাবন্দী রয়েছেন বলে দাবি করেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্মমহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক।

গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সব নেতা-কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে হেফাজত যা করার, তা-ই করবে।’

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, শাপলা চত্বরে আমাদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তার জন্য দায়ী তৎকালীন সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নামাজরত এবং ঘুমন্ত এতিমদের ওপর যেভাবে গুলি চালানো হয়েছিল, সেটি ইতিহাসে একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার দাবি করেন মুহিউদ্দিন রাব্বানী।

হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে।

মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়েছে। বাকিরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক, পুলিশের সাবেক ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলাম।

এদের মধ্যে শামসুল হক টুকু, এ কে এম শহিদুল হক, জিয়াউল আহসান ও মোল্যা নজরুল ইসলাম অন্য মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বাকি ৫ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

বিএনএনিউজ/ শাম্মী

Loading


শিরোনাম বিএনএ