28.8 C
আবহাওয়া
৮:৪৪ অপরাহ্ণ - মে ১৪, ২০২৫
Bnanews24.com
Home » চসিকের কোটি টাকার খেয়াঘাট বাণিজ্য!

চসিকের কোটি টাকার খেয়াঘাট বাণিজ্য!

চসিকের কোটি টাকার খেয়াঘাট বাণিজ্য!

বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী শুধু একটি জলপথ নয়— এটি দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো মানুষের জীবনরেখা। কর্ণফুলী ও আনোয়ারার কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ প্রতিদিন শহরে যাতায়াত করেন নৌকায়। এই যাতায়াত নির্ভর করে সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রিত খেয়াঘাটগুলোর ওপর।

তবে এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ যে কেবল নৌকাওয়ালাদের হাতে নেই, সেটি এখন প্রকাশ্যে। প্রমাণ মিলছে সল্টগোলা ঘাটে— যেখানে ‘খাস কালেকশন’র নামে এক বছরে গায়েব হয়েছে সরকারের প্রায় ২৫ লাখ টাকার রাজস্ব।

নামেই ‘খাস কালেকশন’— প্রকৃত অর্থে এটি যেন রাজনৈতিক তদবির ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গড়ে ওঠা এক অর্থ লুটের সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, ইজারা প্রক্রিয়া বানচাল করে পরিকল্পিতভাবে বছরের পর বছর এই ঘাটকে ‘খাস আদায়যোগ্য’ রাখা হয়, যাতে নিয়মের বাইরে রাজস্ব আদায় করে সেই টাকা ভাগাভাগি করা যায়।

চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলা ঘাট থেকে কর্ণফুলীর ডাঙ্গারচর ঘাটে চলাচল করেন প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারেরও বেশি যাত্রী। জনপ্রতি ভাড়া ১৫ টাকা ধরে প্রতিদিন আদায় হয় ৩০ হাজার টাকারও বেশি। বছরে সেই অঙ্ক গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে এক কোটি টাকার বেশি! অথচ এর মধ্যে সরকারের কাছে যাচ্ছে সামান্য কিছু— কোনোটিই নির্ভরযোগ্য হিসাব নয়, নেই অডিট, নেই স্বচ্ছতা।

সূত্র বলছে, চসিক কর্তৃপক্ষ ঘাটটি নিয়মমাফিক ইজারা না দিয়ে বছরের পর বছর ‘খাস আদায়’ চালু রাখে। ১৪৩১ বাংলা সনে (২০২৪-২৫) পুরো বছর খাস আদায় হয়েছে। প্রথমে ঘাটের দখলে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা, পরে দখল নেন বিএনপিপন্থী কিছু লোকজন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই দখল বদলের পরেও চসিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বদলায়নি— তারাও রয়ে গেছেন ভাগাভাগির কাঠামোতেই।

১৪৩২ বাংলা সনের (২০২৫-২৬) শুরুতে চসিক ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। প্রথম দফায় টেন্ডার আহ্বান করলেও, স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দাপটে কেউ ফরম কেনার সাহস পাননি। দ্বিতীয়বার টেন্ডার আহ্বান করলেও ২২-২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আগ্রহী লোকজন চসিক অফিসে গিয়ে ফিরে এসেছেন খালি হাতে— কারণ, ফরম বিক্রি-ই হয়নি!

ডাঙ্গারচর এলাকার পাটনিজীবী মো. ওসমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে ঘাটে কাজ করি। এবার ইজারার কথা শুনে তিন দিন যাবত ঘুরেও ফরম পাইনি। এস্টেট অফিসে গেলে সবাই চুপ।’

শেষ পর্যন্ত, ২৮ এপ্রিল অর্থাৎ ফরম জমাদানের একদিন আগে চসিক হঠাৎ একটি নোটিশ জারি করে জানায়— ‘সংস্কারের প্রয়োজন থাকায় সল্টগোলা ঘাটের নাম টেন্ডার তালিকা থেকে প্রত্যাহার করা হলো।’ অথচ তখন পর্যন্ত কোনো সংস্কার হয়নি, এবং এর আগেও এমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগও ছিল না।

দেখা যায়, একটি ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে পাওয়া চুক্তিপত্রে দেখা যায়, চসিকের এস্টেট শাখার চেইনম্যান মো. সিরাজ উদ্দিন দায়িত্ব দেন বিএনপিপন্থী নেতা আবদুল আহাদকে। আবার আহাদের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন ফয়সাল নামে এক যুবদল নেতা। আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, পুরো ঘাট ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে পাঠানটুলির আক্তার হোসেন বাবুল ও ডাঙ্গারচরের আনোয়ারুল আজিমের ছেলে আল ফয়সাল।

চলমান বাস্তবতায় খাস আদায়ের মাধ্যমে দৈনিক ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হচ্ছে। অথচ খরচ বাদে প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ হাজার টাকা থেকে যাচ্ছে হাতে। এই অর্থ যাচ্ছে কোথায়? চুক্তিপত্রের ভাষা অনুযায়ী— এটি ‘সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জমা দেওয়া হবে।’ তবে কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই, নেই কোনো গ্রহণযোগ্যতা।

প্রশাসনিক ‘নীরবতা’ কি প্রশ্রয় নয়?

চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম সরওয়ার কামাল বলেন, এ বিষয়ে মেয়রের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম যদিও বলেন, ‘টেন্ডার হয়নি, তাই খাস কালেকশন চলছে। আমরা সংস্কার করে আবার টেন্ডার দেব।’

তবে ‘খাস ভাগাভাগি’ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, “আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে আমার জানা মতে, এমনটি নয়।” এই ‘জানা মতে নয়’— উত্তরটির মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে পুরো সমস্যার মর্মকথা। চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন কে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ করেন নি।

সল্টগোলা ঘাট যেন শুধুই একটি খেয়াঘাট নয়— এটি এখন রাজনৈতিক আধিপত্য, প্রশাসনিক উদাসীনতা, আর করপোরেশনের রাজস্ব বাণিজ্যের এক প্রতীক। যেখানে ইজারার নামে বছরের পর বছর ধরে নাটক চলে, এবং ‘খাস কালেকশন’ নামে হাজারো যাত্রীর ঘামে জড়ানো টাকা গড়ায় কিছু নেতা ও কর্মকর্তার পকেটে।

এই প্রক্রিয়া শুধু আর্থিক নয়— এটি চট্টগ্রাম নগরের সুশাসন, জবাবদিহিতা ও আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নকেও উপেক্ষিত করে। তাই দরকার এখনই— এই অপ-ছায়ার উৎস খুঁজে, দায়ীদের চিহ্নিত করে, ঘাটটির ইজারা প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে নিশ্চিত করা। নইলে কর্ণফুলীর ঢেউয়ে প্রতিদিন ভেসে যাবে সরকারের লাখো টাকা রাজস্ব— কোনো হিসাবেই যা আর ফিরে আসবে না।

বিএনএনিউজ/ নাবিদ

 

Loading


শিরোনাম বিএনএ