।।মনির ফয়সাল।।
বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারি স্থবির করে দিয়েছে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বকে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ধাক্কা লেগেছে, তাতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। জীবিকার তাগিদে যারা চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভাড়ায় থাকতেন, করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারা, আয় কমে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতায় তারা চলে গেছেন বাড়িতে। দেশে সংক্রমণের ঘটনা বছর পার এবং পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হলেও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া সংকট কাটে নি। অনেক ভবনে এখনও খালি বাসা। টু লেট ঝুলছে নগরীর প্রায় বেশিরভাগ ভবনে। যদিও ঘরভাড়া কমে নি। যারা বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য শহরে থাকতেন তারাও করোনাকালে শহর ছাড়েন। স্কুল কলেজ খোলার সংবাদে তারা ফের শহরে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রায় প্রতিটি ভবনে ১/২টি বাসা, ফ্ল্যাট খালি থাকায় বাড়িওয়ালা ও মালিকদের দুচিন্তার শেষ নেই। কারণ, ভাড়াটিয়া থাক বা না থাক আয় কর, হোল্ডিং ট্যাক্স তো মাফ নেই, সে সাথে দিতে হচ্ছে পানি ও গ্যাস বিল। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে নিজেই ভাড়াটিয়া খুঁজছেন অনেক বাড়িওয়ালা।
বিলস লেবার রিসোর্স অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য মতে, চট্টগ্রামেই ৪৭টি পোশাক কারখানায় ২২ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। আর যারা চাকরি করছেন তাদের বেতন দেয়া হয়েছে ৬০-৬৫ শতাংশ। করোনায় স্বাস্থ্য খাতের শ্রমিকরা আংশিক, হোটেল, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেশন শ্রমিকসহ বহু শ্রমিক পুরোপুরি আয়শূন্য ছিল। কর্মহীন লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। কর্মহীন হওয়ায় দারিদ্র্য বেড়েছে ১৯ শতাংশ ও দরিদ্র জনসংখ্যা বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট আরাকান হাউজিং সোসাইটিতে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন আবদুস সালাম। তিনি ইপিজেডের ইউনিভোগ গার্মেন্টস কোম্পানিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন। কিন্তু করোনায় প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের কবলে পড়লে ছাঁটাই করা হয় অনেক শ্রমিককে। যেখানে কাজ হারিয়েছেন আবদুস সালামও। চাকরি হারানোর পর নতুন কাজ না পাওয়ায় বাসা ভাড়া এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণে হিমশিম খেতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি রাউজানে চলে যান। আবদুস সালামের মতো কাজ হারানো অনেকেই প্রতিদিন শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমান।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা প্রবাসী পরিবারের। বিশেষ করে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, পটিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার শতাধিক প্রবাসী পরিবার রয়েছে। কিন্তু গত বছরের মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে থেকে এসব পরিবারে সংকট শুরু হয়। প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে না পারায় বাসা ভাড়া আটকে যায়। শতাধিক পরিবার বাসা ছেড়েছে। অনেক প্রবাসী পরিবার বাড়িওয়ালার কাছে ভাড়া মওকুফ চেয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।
চট্টগ্রামের এনজিও সংস্থা ‘ইপসা’ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে। ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনমজুর। তাদের ৬৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবহন শ্রমিক ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, ছোট ব্যবসায়ী ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, গার্মেন্ট শ্রমিক ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ছোট পোলট্রি, ডেইরি গরুর খামারের মালিক ১ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মসংস্থানমুখী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ যুবক। ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ মনে করে ২৬-৫০ শতাংশ মানুষ খাবারের অভাবে ভুগছে।
এদিকে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ ভাড়া কমিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না বাড়িওয়ালারা। চট্টগ্রাম নগরীর চাঁন্দগাঁও আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, কল্পলোক আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।
নগরীর সিডিএ আবাসিক এলাকার একটি আবাসিক ভবনের মালিক সৈয়দ হোসেন জানান, তার ভবনে দুটি ফ্ল্যাাট দুই মাস ধরে খালি পড়ে আছে। আরো একটি ফ্ল্যাাটের ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়বেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এখন নতুন করে ভাড়াটিয়া আসছেন। আগে যে ফ্ল্যাটের ভাড়া ১৭ হাজার টাকা ছিলো, সেই বাসা এখন ১৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। তারপরও ভাড়াটিয়া মিলছে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরের মোড়ে মোড়ে এখন ঝুলছে ‘টু-লেট’ নোটিশ। কেউ বাসা ভাড়া দেওয়ার নোটিশ দিয়েছেন। কেউ-বা দোকানঘর ভাড়া দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আগে এমন নোটিশ সংশ্নিষ্ট বাসা বা দোকানের ওপর ঝোলানো হতো। কিন্তু এখন শহরের মোড়ে মোড়ে ঝোলানো হচ্ছে টু-লেট। আবাসিক এলাকার টু-লেট গলির মুখেও ঝোলাচ্ছেন বাড়ির মালিকরা।
দক্ষিণ খুলশী এলাকায় অবস্থিত গরীবউল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটিতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ভবনের দরজায় ঝুলছে ‘টু-লেট’। কথা হয় এ আবাসিকের ১ নম্বর সড়কের চার তলা ‘অপু ভবন’ এর কর্মচারী নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, এ বাসায় ‘১৭টি ফ্ল্যাট আছে। এর মধ্যে ৫টি ফ্ল্যাট দীর্ঘ তিন মাস ধরে খালি আছে। এর মধ্যে কোনো ভাড়াটিয়াই বাড়ি দেখার জন্য আসছে না।
চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট আরাকান হাউজিং সোসাইটি, আরমান হাউজিং সোসাইটি, বহদ্দারহাট সিডিএ আবাসিক, বাকলিয়া কল্পলোক আবাসিক, কোতোয়ালি হেরিটাইজা আবাসিক, চকবাজার জয়নগর আবাসিক, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক, বায়েজিদে কসমোপলিটন আবাসিক, হিলভিউ আবাসিক, শেরশাহ আবাসিক, খুলশী পূর্ব নাসিরাবাদ আবাসিক, আগ্রাবাদ ও বন্দর এলাকাসহ সব কটি এলাকায় ঝুলছে অসংখ্য ‘টু-লেট’।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় করোনাকালের চার মাসে চাকরি হারিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে নিম্নবিত্ত যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্তও। ক্যাবের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দার ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। এখন যারা গ্রামে ফিরেছেন তাদের কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ-বা করোনায় হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। ব্যবসা করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে বাসা ছাড়ার নোটিশ দেওয়া পরিবারও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।
ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, মানুষের জীবন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে করোনা। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কেউই এখন ভালো নেই। আবার করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তও বেশি হয়েছেন এই দুই শ্রেণির মানুষ। আবার এদের ভালো না থাকার প্রভাব পড়েছে কোনো কোনো উচ্চবিত্তের ওপর। যারা বাড়ির মালিক, তাদের একের পর এক ফ্ল্যাট ছাড়ছে এরা। এর প্রভাবে জীবনযাত্রা পাল্টে যাচ্ছে তাদেরও। সবমিলিয়ে করোনা মানুষকে দিয়েছে নতুন অভিজ্ঞতা,পরিবর্তন করে দিয়েছে জীবন যাপনের পদ্ধতি ও অনেকের পেশাও।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্টান খোলার সংবাদে শহরগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকরা ফিরে আসলে আশা করা হচ্ছে শহর হয়তো আবারও প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পাবে। যারা বাড়িকে স্কুল কলেজ করার জন্য ভাড়া দিয়েছেন তাদেরও মনে স্বস্তি ফিরেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার খবরে।
সম্পাদনায়: এসজিএন