।।রেহানা ইয়াছমিন।।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করতে অনুরোধ করে। এর পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সে সময় রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডোর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।

বাংলাদেশ এই করিডোর প্রদানের জন্য নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে ফ্যাসিজমের দিকে হাটতে শুরু করেছে বলে মনে করছে দেশের রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক সংগঠনসহ বেশিরভাগ মানুষ।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোরের নামে মূলত: মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্র একটি সামরিক বাফার জোন স্থাপন করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তৎপর রয়েছে । আর জনগণের দৃষ্টি ঘুরাতেই সরকার নারী কমিশন প্রতিবেদন সামনে নিয়ে এসেছে এমন অভিযোগ করেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী।
ড. আব্বাসী আরও আশংকা প্রকাশ করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের গোষ্ঠি স্বার্থে জাতি ও দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দাড় করিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে মিয়ানমার, চীন ও রাশিয়ার বিপক্ষে। যার খেসারত দিতে হবে বাংলাদেশকে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে এবং পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে, মানাং দ্বীপ এবং গুরুত্বপূর্ণ চকপিউ বন্দরের নিয়ন্ত্রণ এখনো জান্তার হাতে।
মিয়ানমারের নৌবাহিনীও সেসব এলাকায় তাদের অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান তীব্র সংঘর্ষের কারণে রাখাইনের সাধারণ জনগণের জীবন বিপর্যস্ত। এই ভোগান্তি আরো বাড়াতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের সরবরাহ পথ বন্ধ করে রেখেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) রাখাইনে মানবিক সংকটের বিষয়ে জানিয়েছিলো যে, রাখাইনে তীব্র মানবিক সংকট, ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ বিধ্বস্থ মিয়ানমারের মধ্যে রাখাইনে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের পাশাপাশি জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ– রোহিঙ্গা, রাখাইন এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে বিবাদমান পক্ষের কারণে বেশিরভাগ মানুষই মানবিক সহায়তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিলে রাখাইনের আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন জনসংখ্যার চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে।
রাখাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘ আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখলে নিলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে ইউএনএইচসিআর আর আর আর সি কার্যালয়কে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, মিয়ানমার জান্তা সরকারের মতো আরাকান আর্মির মধ্যেও রোহিঙ্গা বিদ্বেষ রয়েছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তা কমেনি এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি।
রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় রোধে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে করিডোর চালু করার জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সম্মতি প্রয়োজন। কোনো এক পক্ষ রাজি না থাকলে এই করিডোর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জান্তা সরকারকে বাদ দিয়ে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত রাখাইনে এই করিডোরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
মিয়ানমার সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে যোগাযোগের বিষয়ে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্র দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। জান্তা সরকার আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে বাংলাদেশ কেনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে।
বিএনএ/ওজি