বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক দেয়াং পাহাড়। প্রাচীন এ পাহাড় বুনো এশিয়ান হাতির আবাসস্থল। পাহাড়ে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, শিল্প স্থাপনা নির্মাণে সংকুচিত হয়েছে হাতির সে জগৎ। নিজেদের করিডোরে মানুষের আনাগোনা সহ্য করছে না সবচেয়ে বড় স্থলচর প্রাণীটি।
সম্প্রতি বন্যহাতির আক্রমণে তিনজনের মৃত্যুর পর বিষয়টি বেশি আলোচনায় এসেছে। দেয়াং পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কোরিয়ান এক্সেপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) কর্তৃপক্ষ ও গ্রামবাসী চান, ওই এলাকা থেকে হাতি সরানো হোক। তবে বন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বন্যহাতি এভাবে সরিয়ে ফেলা ‘সম্ভব না’। ফলে দেয়াঙ পাহাড়ে হাতি-মানুষের ‘দ্বন্দ্ব’ লেগেই আছে ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষই হাতির আবাসস্থলে বসতি গড়ে তাদের স্বাভাবিকতা নষ্ট করেছে। হাতি মানুষের বসতিতে আসেনি। এ পাহাড় বন্যহাতির পূর্বপুরুষদের আবাসস্থল। তাদের এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া সহজ নয়।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চক গুচ্ছগ্রামে হাতির আক্রমণে মো. দুলাল (৫০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই রাতেই ইউনিয়নের বৈরাগ এলাকায় ঘরের সামনে হাতি দেখে জ্ঞান হারিয়ে মারা যান মো. আক্তারের স্ত্রী রেহেনা আক্তার (৩৫)। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুরে হাতির আক্রমণে নিহত হন কৃষক মোহাম্মদ ছৈয়দ (৫৭)।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, দেয়াং পাহাড় থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে চুনতি অভয়ারণ্য ঐতিহাসিকভাবে হাতির করিডোর। হাতিরা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এসব এলাকায় বসবাস করছে। মানুষ চাইলেই তাদের আবাসস্থল থেকে সরিয়ে দিতে পারে না।
বিগত এক দশক ধরে এসব ঘটনার পর দেয়াং পাহাড়ের আশপাশের গ্রামের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করেই আছে। খাবারের খোঁজে প্রায় প্রতি রাতেই গ্রামে হানা দিচ্ছে হাতির দল। গ্রামবাসী বাঁশি, ঢাকঢোল, পটকা ফুটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছে। বিক্ষোভ-মানববন্ধনও হয়েছে।
এ অবস্থায় দেয়াং পাহাড়ের এসব হাতি সরিয়ে নিতে উপজেলা প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়েছেন স্থানীয়রা। জেলা প্রশাসনকে একই দাবি জানিয়েছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। তবে বন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেয়াং পাহাড় হাতিগুলোর পূর্বপুরুষের আবাসস্থল। নিজেদের করিডোরে (চলাচলের পথ) বসতি স্থাপন তারা সহ্য করতে পারছে না। মানুষের বাধার পরও ওই হাতির দলটি এ এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে না।
আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চকে দেয়াং পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ভূমিহীনদের গুচ্ছগ্রাম। সম্প্রতি এখানে হাতির আক্রমণে একজনের মৃত্যু হয়।
কেইপিজেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মুশফিকুর রহমান জানান, হাতি সরিয়ে নিতে কেইপিজেডের এই দাবি নতুন নয়। দেয়াং পাহাড়ে বসবাসরত তিনটি এশিয়ান বুনো হাতিকে তাড়িয়ে দিতে এর আগে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ২২টি চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
২০২১ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসককে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, কেইপিজেড বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মস্থল। কিন্তু গত তিন বছর বন্যহাতির একটি পাল ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে। তিন বছরে হাতির আক্রমণে কেইপিজেড ও আশপাশের এলাকার ১০ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি করেছে। বর্তমানে প্রতি রাতেই হাতিগুলো কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে। এখনই এ হাতিগুলো কেইপিজেড এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া না হলে ক্ষতির মুখে পড়বে আন্তর্জাতিক মানের এ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলটি।
পাহাড়ের বেশ বড় একটি অংশ কেটে স্থাপনা তৈরি করছে কোরিয়ান ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাহাড় কেটে বন ধ্বংস করার ফলে আবাসস্থল হারাচ্ছে হাতি।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ১২ বছরে বন্যহাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এছাড়া বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাঠের ফসল ক্ষতির অভিযোগে স্থানীয় থানা ও বন বিভাগে মামলার ঘটনাও আছে।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘হাতি মানুষের জায়গায় যায়নি, মানুষই হাতির বাড়িতে ঢুকেছে। কোরিয়ান ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে যে ২৪শ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কলকাতা গেজেট অনুসারে তার মধ্যে ৪৬৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জমি দেওয়ার শর্ত ছিল ৩৩ শতাংশ বন ও পশু-পাখির জন্য সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু এখন তারা পাহাড় কেটে, বন ধ্বংস করে ভবন নির্মাণ করছে। এ কারণে নিজের আবাসস্থল হারিয়ে হাতি আশপাশের গ্রামবাসীর ক্ষতি করছে।’
তিনি অরো বলেন, ‘কোনো কারণে যদি জোর করে হাতি এই অভয়ারণ্য থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা হিতে-বিপরীত হতে পারে। এর আগে অনেকবার এমন চেষ্টার পর মানুষের বাড়ি-ঘরে হাতির হামলার ঘটনা ঘটেছে।’
বিএনএনিউজ/ নাবিদ/শাম্মী