বিএনএ, ঢাকা : দেশের সর্বত্র খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের উপর ন্যাস্ত। ১৯৮৮ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহের পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়। যা ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২০১২ সালে ওয়াসার পক্ষ থেকে পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানায় ঢাকা ওয়াসা। যার পরিপ্রেক্ষিতেই গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
সোমবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে কারওয়ানবাজারের ওয়াসা ভবনে আয়োজিত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে আয়োজিত এক মত বিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশনের ইতিহাস তুলে ধরে তাকসিম এ খান বলেন, ১৯৮৮ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সরকার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে ঢাকা ওয়াসার উপর ন্যস্ত করে। এরপর থেকে ঢাকা ওয়াসাসহ সিটি কপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজউকসহ সাতটি সংস্থার মাধ্যমে ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কাজ পরিচালনা করে আসছিল।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়োজন বলে মত দেন। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসা অনুধাবন করে ১৯৮৮ সালে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন সংক্রান্ত জারিকৃত অধ্যাদেশটি ঢাকা ওয়াসা অ্যাক্ট-১৯৯৬ এর সাথে সাংঘর্ষিক। এর প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে পয়ঃনিষ্কাশনের কাজটা সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা ওয়াসার অনুরোধে কারিগরি কমিটিসহ বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে জানিয়ে তিনি বলেন, বিবিধ কারণে ওই সময়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব সাত হাতে না করে একহাতে রাখার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন। ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব হস্তান্তর করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেন তিনি।
২০১৯ সালে মন্ত্রী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার বিষয়ে নানা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা সিটি করপোরেশনেরর নবনির্বাচিত মেয়ররা ২০২০ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাদের নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী গত ২৬ নভেম্বর একটি পরামর্শ সভা করেন এবং সিদ্ধান্তে আসেন, ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা দুই সিটি করপোরেশনের কাছে ন্যস্ত হওয়া সমীচীন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ ডিসেম্বর বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।
তাকসিম এ খান বলেন, খাল ব্যবস্থাপনার বহুমুখি দিক থাকলেও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে আমরা সলিড ওয়েস্ট সরানো এবং পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে খাল খণনের কাজগুলো করেছি। যা সলিড ওয়েষ্ট ম্যানেজম্যান্ট এবং পুরো ড্রেনেজ ব্যবস্থা হিসেবে এ দায়িত্ব শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনের।
ওয়াসার এমডি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ সালে একাধিকবার স্থানীয় সরকারকে জানানো হলে, ২০১৫ সালে সাবেক মেয়র আনিসুল হক এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন হলেও বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৯ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২০ সালে ঢাকার মেয়রদ্বয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। ৩১ ডিসেম্বর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকার ৩৬০ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা (বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন, খাল ব্যবস্থাপনাসহ সকল ড্রেনেজ ব্যবস্থা) এককভাবে সিটি করপোরেশনের উপর ন্যাস্ত করা হচ্ছে। ওয়াটার ডেভোলপমেন্ট বোর্ডও তাদের দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
আমরা বলেছি, আমাদের যত টেকনোলজি, ইকুইপমেন্ট, প্রয়োজনে জনবল দিয়ে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে। দুই বছর পর্যন্ত তারা সিটি করপোরেশনে দায়িত্ব পালন করবে, দক্ষতা প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসবে। যদি কেউ স্থায়ীভাবে থাকতে চায় তাও সম্ভব। দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, খাল ব্যবস্থাপনার মধ্যে ছিলো পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু রাখা, বর্তমানে তা সচল রয়েছে। কাজটি ৭ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো।
তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকায় জলযট শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে যে পরিমান জলায়য় থাকা প্রয়োজন তা নেই। পানি ধরে রাখার জায়গা না থাকায় এই জলজট সৃষ্টি হয়। জলজটের সময় নির্ভর করে কত মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বা কত সময়ে এ পানি পাম্প করা যাচ্ছে। ভ‚গর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলনের মাধ্যমে ভ‚মি ধসের সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, যে পরিমান উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে এ ধরনের ঘটনার কোন সাইন্টেফিক ভিত্তি নেই। এছাড়াও বৃষ্টির পানি পানিচক্রের কাজ করে। খালগুলোর মাধ্যমে পানি মাটির গভিয়ে পৌঁছে। ভ‚গর্ভস্থ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পানি উঠালে প্রাকৃতিক ভাবে তা পূরণ হয়। বর্তমানে আমরা ৬৬ শতাংশ পানি উত্তোলন করছি। তবে দ্রæতই সারফেস ওয়াটার পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
রেভিনিউ বিষয়ে বলেন, নিন্ম আয়ের বা বস্তিবাসীরদের মধ্যে বিল পরিশোধ করে ৯৫ শতাংশ জনগণ। বিপরীতে গুলশান-বনানী এলাকায় কারো কারো ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাকি থাকে। বৈষম্য দূর করতে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করা হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা শুরু করেছি ১৪ মাসের বকেয়া নিয়ে, সময়ের সাথে আমরা তা সাড়ে চার মাসে নিয়ে এসেছি। বেষ্ট প্রেকটিস হচ্ছে তিন মাস। আমরা দ্রæত সে স্থানে চলে আসছি।
তিনি আরও বলেন, আমরাও ডিজিটাল ওয়াসা হয়ে যাচ্ছি। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ। আমরা ২০১০ সালে বলেছিলাম, আমরা চাই ডিজিটাল ওয়াসা। ২০২১ সালে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি, ডিজিটাল ওয়াসার অনেক কাছাকাছি চলে আসছি আমরা। আমাদের বেশ কিছু বিষয় কম্পিউটারাইজ করে ফেলেছি। এখন চেষ্টা করছি ওয়েবের মাধ্যমে পানির রিডিং দেখে বিল করার।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে ঢাকা শহরে উদ্ধৃত পানি উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আশা করছি এ বছরও উদ্ধৃত পানি উৎপাদন করতে সক্ষম হবো। চলতি বছর রাজধানীতে পানির কোনো ঘাটতি হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াসা এমডি বলেন, ওয়াসা কখনও ড্রেনেজ সিস্টেমের অথরিটি ছিল না। এখনও নেই। ১৯৮৮ সালের প্রজ্ঞাপনটি ভুল ছিল। প্রজ্ঞাপনটি বলে দিচ্ছে এটা ঢাকা ওয়াসার কাজ না। ওয়াসা শুধু এ কাজটি একা করতো না, আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করতো। যদি পাঁচ থেকে ছয় প্রতিষ্ঠান মিলে একটি কাজ করে তাহলে সেই কাজটি কী সঠিক হবে? সঠিকভাবে কাজটি করতে হলে একজনকেই করতে হবে। কাজেই সেই একজন হচ্ছে সিটি করপোরেশন। ওয়াসার যতটুকু দায়িত্ব ছিল ততটুকুই পালন করেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকাকে শতভাগ স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে উল্লেখ করে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকার সমস্ত পানি সরবরাহ লাইনকে নতুন করে পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে। এজন্য ঢাকাকে ১৪৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়াও এলাকা ভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিএনএনিউজ/ এসকেকে/এইচ.এম।