বিএনএ, ঢাকা: ১ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে ভারত সর্ম্পকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের এমন মন্তব্য বাংলাদেশ-ভারতের চলমান ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ বা কোল্ড ওয়ারের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত এক সপ্তাহ ধরে দুই দেশের মধ্যে তীব্র টানাপোড়েন চলছে। যার রাজনৈতিক পরিভাষা স্নায়ু যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার।
১৯৪৫ সালে স্নায়ু যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল। স্নায়ু যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রসমূহ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রসমূহের মধ্যকার টানাপোড়েনের নাম। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০’র দশকের শেষ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী সময়কালে এই দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যকার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারা নিয়ন্ত্রণ করত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের স্বপক্ষে; আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশসমূহ ছিল সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রপন্থী। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও কানাডা। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ছিল পূর্ব ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র, যেমন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি ও রোমানিয়া।
স্নায়ু যুদ্ধে প্রতিপক্ষ দেশগুলো সরাসরি লড়াইয়ের মুখোমুখি না হয়ে একে অপরকে হুমকি, সামরিক ও পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শন, মহাকাশ প্রতিযোগিতা, ছোটখাটো যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি উপায়ে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। অর্থাৎ লড়াইগুলো কখনোই গরম বা ভয়াবহ হয়ে উঠেনি, সবসময় ঠাণ্ডা বা শান্তই ছিল। তবে শান্ত বা ঠাণ্ডা হলেও এগুলো ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ।
১৯৪৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভেঙে যাবার আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাটকীয় পরিবর্তন ও পতনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
গত ৫ আগস্টের বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত টানাপোড়েন তথা স্নায়ু যুদ্ধ চলে আসছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত স্বাগত জানায়নি। উল্টো সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে লুট, অগ্নি সংযোগ, মন্দিরে হামলা, সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার, বুয়েটে ভারতীয় পতাকা পদদলিত করার ঘটনায় ভারতের ত্রিপুরা, আগরতলা, কলকাতাসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী রাজ্যে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। এমনকি বিজেপির সদস্যরা আগরতলায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার দপ্তরে হামলা করেছে, জাতীয় পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
এই বিস্ফোরণমূখ পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়, আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ এবং হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তাব দেন।
এদিকে, সোমবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রস্তাবের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে শান্তিরক্ষী পাঠানো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে প্রস্তাব করেছেন তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘তার অবস্থানের জন্য সহায়ক হবে না’ বলে মতপ্রকাশ করেছেন তিনি।
সোমবার বিকেলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এরপর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকভাবে খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে – এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে রয়েছে।
বাংলাদেশে যখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বিদেশি কুটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন, তখন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি নামের একটি সংগঠনের সভা ছিল আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের সামনে। সভা শেষে সংগঠনের ছয়জনের একটি প্রতিনিধি দল হাইকমিশন কার্যালয়ের ভেতরে যায় স্মারকলিপি জমা দিতে।
এসময় বাইরে থাকা কিছু হিন্দু যুবক হঠাৎ বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিড়ে ফেলে এবং পরবর্তীতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকার অবমাননার নিন্দা জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের এক্স হ্যান্ডেলে লেখা হয়েছে, কোনও অবস্থাতেই কূটনৈতিক সম্পত্তিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা উচিত নয়।
এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘ভারত নিজের দেশে তার প্রতিবেশি দেশের কুটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা দিতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার কোন অধিকার তাদের থাকতে পারে না। বাংলাদেশ তাদের মাথার উপর কারো দাদাগিরি একদম পছন্দ করে না। জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, জাতীয় ঐক্যই তার কার্যকর ঔষধ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারত এখন পরস্পরকে বন্ধু ভাবছে না, দুই দেশের মধ্যে বৈরি মনোভাব একটি অস্থিতিশীল সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের জন্যই যা অমঙ্গল বয়ে আনবে— সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিএনএনিউজ/ সৈয়দ সাকিব/ বিএম/এইচমুন্নী