বিএনএ, ঢাকা: দেশে একটি প্রবাদ চালু আছে সরিষায় ভূত! এই প্রবাদের উৎপত্তি ইতিহাস প্রতিবেদকের জানা নেই। তবে এটি ধারণা করা যায়, ওঝা বা মোল্লা মৌলবীরা সরিষা দিয়ে ভুত তাড়ান। কিন্তু সেই সরিষায় যদি ভেজাল থাকে তা হলে ভূত তাড়ানো সম্ভব নয়। বলছি, কক্সবাজার জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন, কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদার, বাদীপক্ষের আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরীর কথা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে জমি অধিগ্রহণের ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তৎকালীন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন। এখানেই থেমে থাকেননি করিৎকর্মা রুহুল আমিন। এ ব্যাপারে তাকে ১ নম্বর আসামি করে ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ওই মামলায় বাদীর স্বাক্ষর ও নথি জালিয়াতি করে নিজের নাম কেটে দেন প্রধান আসামি সাবেক জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদারসহ চারজন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিনের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার (১ জুলাই) কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, হুলিয়া ও ক্রোক-পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়।
আদালত ও দুদক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বর মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জমি অধিগ্রহণের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনকে প্রধান আসামি করে ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মাতারবাড়ীর বাসিন্দা এ কে এম কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য দুদককে নির্দেশ দেন। মামলার পরপরই ১ নম্বর আসামি রুহুল আমিনের নাম বাদ দিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নথিপত্র পাঠান তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদার।
আদালতের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুহুল আমিনসহ ২৮ জনের নামের আবেদনটি ওই দিন দুদকের প্রধান কার্যালয় (অনুসন্ধান ও তদন্ত) এর পরিচালক বরাবর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। আবেদনটি দুদকে পাঠানোর জন্য ২০ নভেম্বর সকাল ১০টায় আদালতের কর্মচারী সৈয়দ আকবরকে কক্সবাজার ডাকঘরে পাঠানো হয়। কিন্তু ডাকঘরে পৌঁছানোর আগে তাঁকে আবার আদালতে ফিরিয়ে আনা হয়।
পরবর্তীতে খামটি স্টেনোগ্রাফার জাফর আহমদের মাধ্যমে জেলা ও দায়রা জজ সাদিকুল ইসলামের কাছে পাঠানো হয়। এরপর কৌশলে কাগজপত্র থেকে জেলা প্রশাসক রুহুল আমিনের নাম বাদ দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ১৯ নভেম্বরের মামলা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনের নাম বাদ দেওয়ার ঘটনা জানতে পেরে কয়েকদিন পর একই আদালতে জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন, জেলা জজ সাদিকুল ইসলাম তালুকদারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করেন বাদী কায়সারুল ইসলাম চৌধুরী। সেই মামলার তদন্ত শেষে আদালতে সাবেক জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন ও সাবেক জেলা দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদার ছাড়াও আসামি করা হয়েছে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নাজির স্বপন কান্তি পাল এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্টেনোগ্রাফার মো. জাফর আহমেদকে।
প্রসঙ্গত: নথি জালিয়াতির ওই মামলায় দুদকের কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুর রহিম ও কক্সবাজারের সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এস এম শাহ হাবিবুর রহমানকে আসামি করা হয়। তবে দুদক এই দুইজনকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনে আদালতকে দুদক জানায়, ফৌজদারি দরখাস্ত রেজিস্টারে লিপিবদ্ধের সময় জেলা প্রশাসক রুহুল আমিনসহ মোট আসামি ছিলেন ২৮ জন। পরে তিনটি পৃষ্ঠা পরিবর্তন করে ১ নম্বর আসামি রুহুল আমিনকে বাদ দিয়ে ২ নম্বর আসামি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. জাফর আলমকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। আসামি ২৮ জনের জায়গায় ২৭ জন করা হয়, যাতে বাদীর জাল স্বাক্ষর দেওয়া হয়। পুরো নথিতে কাটাছেঁড়া ও লেখায় ঘষামাজা করে দুদকে পাঠানো হয়। বাদীর জাল স্বাক্ষরের বিষয়টি সিআইডির হস্তলিপি বিশারদের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপভিত্তিক কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৪১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চিংড়ি ঘের, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। চিংড়ি ঘের ক্ষতিপূরণের বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মনগড়া ২৫টি চিংড়ি ঘের দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের ৪৬ কোটি টাকা থেকে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ৩১৫ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানান, শুরুতে চিংড়ির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ২৩ কোটি টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছিল। পরে তিনটি চেক বাতিল করা হয়। এরপর অবশিষ্ট ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার টাকা যাঁরা নিয়েছেন এবং দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সাবেক জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। দুদক দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায়।
আদালত সূত্র জানায়, দুর্নীতির মামলায় ২০১৭ সালের ২২ মে জামিন আবেদন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন। আদালত তার আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়, এর আগে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। একই মামলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জাফর আলম, জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার (এলও) সাবেক উচ্চমান সহকারী আবুল কাশেম মজুমদার, সাবেক সার্ভেয়ার ফখরুল ইসলাম ও কক্সবাজার আদালতের আইনজীবী নুর মোহাম্মদ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তারা সবাই এখন জামিনে রয়েছে। ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার মামলাটি বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
বিএনএনিউজ/শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/এইচমুন্নী,এসজিএন