বিএনএ, ঢাকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ৪দিন আগে এবং চট্টগ্রামে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার অভিযোগে ১৯ জন হিন্দু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার একদিন পর গত বৃহস্পতিবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে যেই মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সবার প্রশ্ন একটাই কেন হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকার পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি ও হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে নিজের মনোভাব জানালেন?
এই নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নানা মুনির নানা মত। তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষকরা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের মধ্যে বড় একটি অংশ ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়। তার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বি বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। স্বাভাবিকভাবে ভারতীয়দের কামলার প্রতি দূর্বলতা রয়েছে। এই ভারতীয়দের ভোটে ভাগ বসাতেই ভোটের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনেছেন ডোনাল ট্রাম্প।
দ্বিতীয়ত, ড. ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক দলের নীতি নির্ধারক, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সর্ম্পক রয়েছে। আর সেই সর্ম্পককে কাজে লাগিয়ে ড. ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছেন এবং নিজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দেশের শাসনভার নিয়েছেন। বিষয়টি প্রতিবেশী দেশ ভারত স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের মোদি প্রশাসনের বিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশের বিষয়ে মোদির প্রতি সমর্থন প্রতিফলন দেখা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় পোস্ট করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই টুইটটিতে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার টুইটে বলেছেন– বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বর’ সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছেন। এসবের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ “বিশৃঙ্খল” অবস্থার মাঝে রয়েছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে কথা বলার পরই তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের প্রসঙ্গ টেনে আনেন মি. ট্রাম্প।
ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে কখনোই “এমনটি” ঘটতো না। কমলা হ্যারিস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন “আমেরিকা ও সারা বিশ্বের হিন্দুদের উপেক্ষা করেছেন।
ট্রাম্প “আমেরিকার হিন্দুদেরকে চরমপন্থী বামদের ধর্মবিরোধী এজেন্ডা থেকে রক্ষা” করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টুইটে বলেন, “আমরা তোমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ব। আমার প্রশাসনের অধীনে আমরা আমাদের মহান অংশীদার ভারত এবং আমার মিত্র প্রধানমন্ত্রী মোদী’র সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করবো।”
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ইঙ্গিত করে বলেছেন “রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়, ট্রাম্পের টুইট তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।” তিনি আরও বলেন“হিন্দু ধর্মাবলম্বী, প্রধানত ভারতীয়দের ভোট নিশ্চিত করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবিরও মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে “ফিড করা হয়েছে”। অর্থাৎ, তাকে এটি বোঝানো হয়েছে। “নয়তো, তার এই ধরনের কথা বলার কথা না। কিন্তু বাংলাদেশের বিষয়ে যে সমস্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন, এইগুলো খুবই শক্ত শব্দ।”
দিল্লির ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ট্রাম্পের এই টুইটকে “অ্যান্টি ইউনূস ক্যাম্পেইন” হিসাবে দেখছেন না। তিনি বরং এটি “অ্যান্টি হ্যারিস বা প্রো-হিন্দু ক্যাম্পেইন” হিসাবে দেখছেন। তিনি বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা অজানা নয়। এর আগেরবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদী সমর্থন করেছিলেন। এখন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আগে সেই বন্ধুত্বকেই কাজে লাগাচ্ছেন ট্রাম্প।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসিক কর্মকান্ডের বিরোধীতা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ডোনাল ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে সারাদেশে আলোচনা চলছে, ঠিক তখন, শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় এলাকায় সনাতন জাগরণ মঞ্চের প্রতিবাদ সমাবেশে বাধা দিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সমাবেশস্থলের যাওয়ার তিনটি পথই বন্ধ করে দিয়েছিল তাঁরা। কিন্তু হাজার হাজার নারী পুরুষের উপস্থিতি এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এক পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পিছু হটে যায়। পরে অনুষ্ঠিত বিশাল ওই সমাবেশ থেকে ১৯ জনের বিরুদ্ধে করা জাতীয় পতাকা অবমানার দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারে সোমবার সকাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানায় সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। দুই মাস ধরে সনাতন জাগরণ মঞ্চ আট দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এর অংশ হিসেবে ২৫ অক্টোবর লালদীঘি মাঠে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশ থেকে যাওয়ার সময় নিউমার্কেট এলাকায় জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে মামলাটি করেন নগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ খান।
সনাতন জাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী তার বক্তব্যে বলেন, জাতীয়বাদী দল বিএনপি ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই তারা মামলার বাদী ফিরোজ খানকে বহিষ্কার করেছে। ফিরোজ খানকে যে ইন্ধন দিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। না হলে বারবার এ দেশের নাম ক্ষুণ্ন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং রিপাবলিক দলের প্রার্থী ডোনাল ট্রাম্প অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মামলা- হামলা ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিষয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কুটনীতিতে হোঁচট খেয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুসারিদের দ্বিতীয় স্বাধীনতার বাংলাদেশ। মোদি-ট্রাম্পের ধাক্কায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কীনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পর্যন্ত।
বিএনএনিউজ/ সৈয়দ সাকিব/ বিএম/এইচমুন্নী