বিএনএ, ঢাবি: আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠা দেশের এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি পা দিয়েছে তার ১০৩ তম বৎসরে। তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টির দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যে অবদান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই জানান দিতে নানা আয়োজনে আজ পালিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই বাংলাদেশের সমাজ উচ্চশিক্ষার পথে হেঁটেছে। বাংলাদেশের শতায়ু পার করা একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। এখনো সারা দেশের সুস্থ চিন্তা বিকাশের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কেন্দ্র এই বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার প্রতি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে বিগত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলা ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন হল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। এ নিয়ে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবারের প্রতিপাদ্য–‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়’।
কর্মসূচি অনুযায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে স্মৃতি চিরন্তন চত্বর থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখে পায়রা চত্বরে গমন করেন। সেখানে সকাল ১০টায় জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশিত হয়।
পাশাপাশি সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে আলোচনা সভা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর এই দিনে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুযোগসুবিধা ও জীবনযাত্রার মান কতটুকু উন্নত সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে নতুন বছর থেকে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, এমনটাই প্রত্যাশা রাখছেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কথা আসলে মৌলিক যে তিনটি বিষয় উঠে আসে সেগুলো হলো—থাকা, খাওয়া ও পড়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি এই তিনটি মৌলিক চাহিদা, এমনটিই জানালেন হলের শিক্ষার্থীরা। তবে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছরের অবস্থা অনেকটা ইতিবাচক বলছেন তারা। তারা চাল এটি আরও বেগবান হোক।
বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার ব্যবস্থা আগে থেকে উন্নত হলেও এখনো তা মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণ করার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সর্বপ্রথম আবাসন সমস্যার মুখোমুখি হয় শিক্ষার্থীরা। বৈধ প্রক্রিয়ায় হলে উঠতে একজন ছাত্রের ন্যূনতম তৃতীয় বর্ষে পা দিতে হয়। ফলে প্রতিবছর একই ধরণে সমস্যায় পড়ে যায় ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরে নিজের ঠাঁই বানাতে অবলম্বন করতে হয় বিকল্প পদ্ধতি। জানা যায়, প্রত্যেকটা হলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন হলের কিছু রুম তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
কবি জসীম উদ্দীন হলের দ্বিতীয় বর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘এরকম গাদাগাদি করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় এটা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। রাতে ঘুমাতে না পারলে মনযোগ দিয়ে ক্লাস করা যায় না। আর্থিক স্বচ্ছলতার থাকলে অনেক আগেই হল ছেড়ে দিতাম। প্রশাসন অনেক সচেতন হয়েছে, তবে প্রত্যাশা থাকবে নতুন বছর থেকে আমাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। মানসম্মত খাবারের অপ্রতুলতার সাথে এখন যুক্ত হয়েছে মূল্য বৃদ্ধি। যার কারণে বেশি টাকা দিয়েও ভালো খাবার খেতে পারছে না হলের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ক্যান্টিনগুলোতে নেই স্বাস্থকর পরিবেশ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আক্তার শরীফ বলেন, ‘শুরুতে কয়েকদিন খাওয়ার পর আমি হল ক্যান্টিনে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তবে এখন কিছুটা ভালো হয়েছে। তারপরও এগুলো পর্যাপ্ত না। একজন শিক্ষার্থীকে কিন্তু তার এই দুইবেলা খাবারের ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাই আমার মনে হয় ক্যান্টিগুলোতে খাবারের মান আরও বাড়ানো উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী আছে ৪৭ হাজার ১৯৭ জন। জানা গেছে ১৮ টি হলে বৈধভাবে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা আছে। তবে তার দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী নানা সংকটে পড়ে ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে থাকছে। যার একটি বিশাল চাপ পড়ছে হলের রিডিংরুমগুলোর উপর। স্বাভাবিকভাবেই হলের রিডিংরুমগুলোতে এত শিক্ষার্থী ধারণের সক্ষমতা নেই। যার ফলে অনেকেই ভোর হতেই ভিড় জমায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। শেষমেশ সেখানেও জায়গা হয় না সবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য লেখাপড়া হলেও সেই সুযোগ যথাযথভাবে পায় না তারা।
বিভিন্ন হলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় টুল-ব্যাঞ্চ বসিয়ে পড়ছেন অনেক শিক্ষার্থী, অনেক জায়গায় দেখা যায় নিউজপেপার রুমেও পড়তে বসেছেন অনেকে।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান জানান, ‘আমাদের হলের রিডিংরুমে অনেকসময় আমরা পড়ার জায়গা পাই না। দেখা যায় আশপাশের ছোট হলগুলো- এ এফ রহমান হল, বঙ্গবন্ধু হল থেকেও অনেকে এখানে পড়তে আসে। তুলনামূলক বড় হওয়ায় এখানে অনেকে ভিড় জমায়। যার কারণে সবার পড়ার সুযোগ হয় না।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে পরিবেশ ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ ‘মাস্টার প্ল্যান’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি। এর মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মান হবে। প্রণিত ‘মাস্টার প্ল্যান’–এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, গুণগত মান ও গবেষণার পরিধি সম্প্রসারিত হবে। একটা সময় গিয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা থাকবে না।
বিএনএ/মোছাদ্দেক,এমএফ/এইচ এইচ