এখন এরা বুঝে ফেলেছে এদের জুলুম করার কায়দা কৌশল। তবে আর বেশি দিন নাই। যদিও জাতি হিসেবে বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি ‘পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোনো ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। এটি আমাদের চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে বাংলাকে শোষণ করেছিল তার চেয়েও উলঙ্গভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছে ইংরেজদের শাসনের সময়ও ইংরেজকে সাহায্য করবার জন্য বাঙালির অভাব হয় নাই । আজও হবে না। তবে যারা ত্যাগ করতে পেরেছে—ত্যাগ করে যাক, দুঃখ ও আফসোস করার কোনো দরকার নাই । সাংবাদিক Rawle Knox একটি সত্য কথা লিখেছেন, ‘If Rawalpindi continues to belive that the revolutionary spirit of Bengal is something of a joke, the Pakistani capital could be making quite a mistake.’
পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত —শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে । পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এদের শোষণ করা হতেছে চারদিক দিয়ে । শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়াও ।
আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাঁচে; থাকতে আর চায় না, এই পাষাণ-কারার ভিতরে । আমার কাছে এসে থেমে গেল। বলল, ‘আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব।’
আমি বললাম, ‘যাও, সকলকে আমার সালাম দিও । আমার জন্য চিন্তা করিও না।’
ওদের দিকে আমি চেয়ে রইলাম । ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে গেল । মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড় । এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম । শক্তি পেলাম মনে । মনে হলো পারব! বহুদিন জেল খাটতে পারব। এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলন তখন কে আর রুখতে পারে?
আমি যে একলা থাকি এ কথা কখনও আমার মন থেকে যায় না। এতে আমার শরীর নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে আমাকে ও আওয়ামী লীগ কর্মীদেরই সরকার বেশি কষ্ট দিতে চায় কারাগারে বন্দি করে । রাতে আমাকে গল্প শোনাল এক কয়েদি কি করে ডাকাতি করেছে তাদের দল । ডাকাতি পূর্বে করে নাই।
সূত্র : কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮৯-৯০, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী