27 C
আবহাওয়া
১০:০৮ পূর্বাহ্ণ - এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন


।। এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন ।।

বিএনএ, কক্সবাজার : তীব্র দাবদাহে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন হয়েছে এবার কক্সবাজারে। চেষ্টা চলছে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে লবণ রপ্তানি করার। এ জন্য

কক্সবাজারে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনিস্টিউট।এই গবেষণা ইনিস্টিউটের মাধ্যমে লবণ উৎপাদনে আসছে আরো প্রযুক্তি নির্ভর চমকপ্রদ সু খবর।

পলিথিন প্রযুক্তির মাধ্যমে ধবধবে সাদা লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প (বিসিক) কক্সবাজারের সাবেক উপ মহা ব্যবস্থাপক ড. সালাহউদ্দিনের হাত ধরে প্রথম সাদা লবণ করে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলক ভাবে চাষীরা । তিনিই কাঁদা লবণ থেকে চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাদা লবণ উৎপাদনে ফিরিয়ে আনেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীতে সরাসরি সমুদ্রের লবনাক্ত পানি পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলন করে মেশিনের সাহায্যে রি সাইক্লিং করে একদিকে লবণ অন্যদিকে বিশুদ্ধ খাবার পানি বের করা হবে। তখন শুষ্ক মৌসুমে লবণ উৎপাদনের জন্য অপেক্ষা করা যেমন লাগবেনা তেমনি ভূ গর্ভস্থ মিঠাপানির জন্য নির্ভর করতে হবেনা উপকূলবাসীদের।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির।

এদিকে ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী উপজেলার মোহরা কাটার বাসিন্দা লবণ চাষের সাথে সরাসরি জড়িত এডভোকেট সাহাব উদ্দীন এ প্রতিবেদককে জানান, সমুদ্রের পানি উত্তোলন করে রি সাইক্লিং এর মাধ্যমে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। এর কারিগরি দিক নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে।

দেশের চাহিদার সমপরিমাণ লবণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত হয়ে আসছে। কোন কোন মৌসুমে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কিছুটা ঘাটতি থাকলে ও আমদানি করে সেই চাহিদা পূরণ করা হয়। আবার লবণের মূল্য কম থাকলে ও চাষীরা লবণ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত থাকে। ফলে চাহিদার সমপরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়না কোন কোন মৌসুমে । এমনকি শুষ্ক মৌসুমে বৈরী আবহাওয়া বা অসময়ে বৃষ্টিপাত হলে ব্যাহত হয় লবণ উৎপাদন। তাই আরো আধুনিকায়ন করে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্প্রসারণের লক্ষ্যে করা হচ্ছে গবেষণা ইনিস্টিউট।

কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ মহা ব্যবস্থাপক মোঃ জাফর ইকবাল বলেন, লবণকে আরো প্রযুক্তি নির্ভর, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনের রূপরেখা তৈরি করার জন্য লবণ গবেষণা ইনিস্টিউটের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

লবণ উৎপাদনের জন্য দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের খুলনা পটুয়াখালী, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকায় সমীক্ষা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের এই কর্মকর্তা। কক্সবাজার জেলার চৌফলদন্ডীতে ৩০ একর জমির উপর নির্মাণ করা হবে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনিস্টিউট।এ প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এ দিকে কক্সবাজার উপকূলের লবণচাষিরা এবার লবণ উৎপাদনে ৬২ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে ।আজ থেকে ৬২ বছর আগে মাঠ পর্যায়ে সমুদ্রের পানি জমিতে তুলে সূর্যতাপে শুষ্ক মৌসুমে কাদা লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়।এর আগে সমুদ্রের লবনাক্ত পানি বড় বড় পাত্রে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কাঠ পুড়িয়ে করা হতো লবণ উৎপাদন।

সম্প্রতি চলতি মৌসুমের সাড়ে ৪ মাসে জেলার ৬৪ হাজার ৪৬৬ একরের বেশি জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ২০ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর এ সময়ে লবণ উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ১৭ হাজার মেট্রিক টন।

বিসিকের তথ্যমতে, এর আগে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২০২১ সালে। সব ঠিক থাকলে চাহিদার ২৩ লাখ ৯৫ হাজার মেঃটন লবণ উৎপাদন করতে সময় লাগবে ৭/১০ দিন। এটি যদি হয় এই প্রচন্ড দাবদাহে চাহিদার চেয়ে বেশী লবণ উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে

আরেকটি রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লবণের মৌসুম শেষ হতে আরও ১০/১২ দিন আছে। এ সময়ের মধ্যে আরও ৪ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ করে লবণ রপ্তানি করা যেতে পারে বলে জানান লবণ মিল মালিক সমিতির নেতারা। লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। এ পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হলে সেটি হবে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬২ বছরের সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন বাড়ার কারণের মধ্যে আছে মৌসুমজুড়ে দাবদাহ পরিস্থিতি, কম বৃষ্টিপাত এবং ৬৪ হাজার ৪৬৬ একর জমির শতভাগে আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তিতে চাষাবাদ। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে আড়াই গুণ লবণ বেশি উৎপাদন হয়।

চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ছয় মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৪ হাজার ৪৬৬ একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে।

বিসিক কর্মকর্তা ও চাষিরা বলেন, চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের জন্য আরও ১০/১২ দিন (১৫ থেকে ২০ মে পর্যন্ত) সময় হাতে আছে। তবে এ সময়ের মধ্যে ঝড়-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা আছে। অন্তত সাত থেকে আট দিন সূর্যের তাপ কিংবা রোদ পাওয়া গেলে আরও তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ২০২০ সালে যখন লবণনীতি করা হয়, তখন দেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি ধরে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়। এখন আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এ ক্ষেত্রে ২০ লাখ মেট্রিক টন লবণ দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের বার্ষিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৩–১৪ দিন ধরে কক্সবাজার উপকূলে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। মাঠে জমানো সমুদ্রের লোনাপানি দ্রুত শুকিয়ে লবণ তৈরি হচ্ছে। গত কয়েক দিন মাঝেমধ্যে আকাশে কালো মেঘ দেখা গেলেও বৃষ্টি হয়নি। তবে পুরো মৌসুমজুড়ে ৩ দফার বৃষ্টিতে ১৫–২০ দিন মাঠের লবণ উৎপাদন বন্ধ ছিল।

দাবদাহে এখন ৬৪ হাজার ৪৬৬ একরের বেশি জমিতে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ২৫ /৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণ।

বিসিকের কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৩০ টাকায়। ন্যায্যমূল্য পাওয়ায় চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বেশ খুশি।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের চাষি আমিন উল্লাহ (৫০) বলেন, প্রচণ্ড দাবদাহ পরিস্থিতিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪২০ টাকায়।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, দাবদাহ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হলেও লবণচাষিদের কপাল খুলে যাচ্ছে। লবণের দামও বেশি পাচ্ছেন। গত মৌসুমে প্রতি মণ লবণ বেচাবিক্রি হয়েছিল ২৮০ টাকায়, এবার ৪২০ টাকার বেশি।

কক্সবাজারের চৌফলদন্ডীর চাষি মনিরুল ইসলাম (৪৭) বলেন, মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও মনে আতঙ্ক থেকে গেছে। কারণ, আকাশে মাঝেমধ্যে কালো মেঘ জমছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। তখন লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশ লবণ উৎপাদন চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, ঝড়–বৃষ্টির শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও চাষিরা মাঠ ছাড়ছেন না। ঝুঁকি নিয়ে লবণ উৎপাদন চালিয়ে গেলেও চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। চাষিদের চাওয়া, প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক।

বিসিকের তথ্যমতে, প্রায় ৪৩ হাজার প্রান্তিক চাষি, লক্ষাধিক শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

লবণের মধ্যস্ত্বভোগী কালারমারছড়র শামশুল আলম বলেন,এ বছর লবণের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি লবণের দাম ও রয়েছে বেশ চড়া। ফলে চাষীরা যেমন লাভবাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ও রয়েছে চাঙ্গাভাব।বিশেষ করে কক্সবাজারের লবণ মিল মালিকরা লবণের চাষ ও করেন, মিলে লবণ চূর্ণ বিচূর্ণ করে আয়োডিন মিশ্রণ করেন।এসব লবণ প্যাকেটিং করে বাজারজাত করে থাকেন।

লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফখরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, লবণের উৎপাদন আরো সম্প্রসারণ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে দেশের উৎপাদিত লবণ বিদেশে ও রপ্তানি করা যেতে পারে।এ উদ্দেশ্যে সরকার লবণ শিল্প উন্নয়নে কক্সবাজারে যে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনিস্টিউট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা অত্যান্ত সময়োপযী পদক্ষেপ। এতে করে লবণ চাষের জমির পরিধি যেমন বাড়বে তেমনি, প্রশিক্ষিত দক্ষ লবণ উৎপাদনকারী শ্রমিকের সংখ্যা ও বাড়বে।ফলে লবণ রপ্তানিকারক খাত হিসেবে প্রতিষ্টালাভ করবে।

দেশের এক তৃতীয়াংশ লবণ উৎপাদনকারী এলাকা মহেশখালী কুতুবদিয়ার সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন,আমি নিজেও লবণ চাষী।এই লবণ শিল্পকে আরো গতিশীল করতে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনিস্টিউট কক্সবাজারের চৌফলদন্ডীতে হচ্ছে।এটি দেশের লবণ শিল্পের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আমরা যে জমিতে শুষ্ক মৌসুমে লবণ উৎপাদন করি আর বর্ষা মৌসুমে সেখানে চিংড়ি চাষ করি। তাই আমাদের জীবন জীবিকা রুটি রুজির ঠিকানা এই দুই ফসলী জমি। চিংড়ি রপ্তানি করে জিডিপিতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছি।পাশাপাশি লবণ রপ্তানি শুরু করতে পারলে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন,আওয়ামীলীগ বা শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকলে লবণ ও চিংড়ি চাষীরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেয়ে থাকে। চাষ পদ্ধতিতে আসে আধুনিকতা।

বিএনএনিউজ/এইচ.এম।

Loading


শিরোনাম বিএনএ