১৮ই জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার সূর্য উঠেছে । রৌদ্রের ভিতর হাঁটাচলা করলাম । আবহাওয়া ভালই । তবুও একই আতঙ্ক–ইত্তেফাকের কি হবে! সময় আর কি সহজে যেতে চায়। সিপাহি, জমাদার, কয়েদি সকলের মুখে একই কথা, “ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে ।’
ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম এমিল জোলা-র লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ (Therese Raquin) পড়ছিলাম সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র-জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময় ।
আজ সিভিল সার্জন আসলেন আমাকে দেখতে শরীরের অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন । বললাম ভালই আছি, ভালই থাকতে হবে । তিনি কাজের লোক, দেরি না করে চলে গেলেন। আমিও বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । বহুদিন পর্যন্ত দু’টি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি । ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর
আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত । আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দু’টি আসল না । ভাবলাম ওরা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও দূরে চলে গিয়াছে । আর আসবে না । ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে একাকী থাকতাম তখন রোজই সকাল বেলা লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বসতাম ওদের দেখার জন্য । মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে ।
খাবার কাজটি কোনোমতে শেষ করে খবরের কাগজের অপেক্ষায় রইলাম আজও অনেক দেরি হলো কাগজ আসতে । ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, আপনি ডিউটিতে আসার পর থেকে কাগজ দেরি করে আসতে শুরু করেছে । কাগজ আসতে দেরি হলে আমার ভীষণ রাগ হয় । দুই এক সময় কড়া কথাও বলে ফেলি ।
প্রায় তিনটার সময় কাগজগুলি কয়েদি পাহারা নিয়ে এল । পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার । এই প্রেস হইতে ‘ইত্তেফাক’, ইংরেজি ‘সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস’ ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’ প্রকাশিত হইত । পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পূর্বের দিন ইত্তেফাক ও নিউনেশন প্রেসের মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছে পূর্ব পাকিস্তানে ইত্তেফাক সকল কাগজের থেকে বেশি ছাপা হয় এর পাঠকের সংখ্যা অসংখ্য । বাংলার গ্রামে গ্রামে ইত্তেফাক পরিচিত । দেশরক্ষা আইনের বলে অন্য কোনো কাগজকে এত বড় আঘাত করা হয় নাই ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে এবং তাহার মালিক ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে ৬ দফার দাবিকে বানচাল করতে চায় । কিন্তু আর সম্ভব হবে না । এতে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠবে । যার পরিণতি একদিন ভয়াবহ হবে বলে আমার বিশ্বাস । কি করে আইয়ুব খান সাহেব মোনায়েম খান সাহেবকে এ কাজ করতে অনুমতি বা নির্দেশ দিলেন আমার বুঝতে কষ্ট হয় ।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১০১-১০২, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬১
কারাগারের রোজনামচা : পর্ব-৬০
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী