বিএনএ, চুয়েট: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একটি হলে গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক শিক্ষকের মদ পান ও এ নিয়ে তাঁর স্ত্রীর চেঁচামেচির ঘটনার তিন মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি তদন্ত কমিটি।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ মে (শুক্রবার) চুয়েটের ৪৯ তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসব উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল মাঠে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। কনসার্টের একপর্যায়ে দিবাগত রাত চারটায় শহীদ তারেক হুদা হলে কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে মদ পানরত অবস্থায় ছিলেন পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক শাফকাত আর রুম্মান। এর কিছুক্ষণ পর তাঁর স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে মদ পানরত অবস্থায় স্বামীকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ও উপস্থিত সবাইকে বকাঝকা করেন। একপর্যায়ে তিনি হলের নিচে নেমে রাস্তায় আহাজারি করতে থাকেন। পরে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জান্নাতুলকে শান্ত করেন ও ওই শিক্ষককে ধরাধরি করে শিক্ষক ডরমিটরিতে পৌঁছে দেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে শহীদ তারেক হুদা হলের প্রাধ্যক্ষ নিপু কুমার দাসের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ৪ জুন দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চুয়েটের গণিত বিভাগের অধ্যাপক সুনীল ধরকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরেও এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান সুনীল ধর বলেন, প্রায় মাসখানেক ধরে চলা শিক্ষকদের কর্মবিরতি এবং ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে তদন্তে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তদন্তের কাজ মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। আগামী রোববার প্রতিবেদন জমা দেয়ার ব্যাপারে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার শেখ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলাকালীন কমিটির সদস্যরা কাজ করতে পারেন নি। পাশাপাশি কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য এখনো তদন্ত প্রতিবেদন কমিটি জমা দিতে পারেনি। রোববার অফিসে গিয়ে আমি তদন্তের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিব। আশা করছি খুব দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
এদিকে ঘটনার তিন মাসেও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা আমাদের রোল মডেল। তাদের থেকে আমরা শিক্ষা নেই। অথচ পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক শাফকাত আর রুম্মান হলে ছাত্রদের সাথে বসে মাদক গ্রহণ করার মতো গর্হিত কাজ করেছেন। সেদিন গভীর রাতে উনার স্ত্রী ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক কাজী জান্নাতুল ফেরদৌস বিনা অনুমতিতে ছাত্রদের হলে প্রবেশ করে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। হল প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এভাবে ছাত্রদের হলে একজন নারী শিক্ষক প্রবেশ করে চেচামেচি করা কোনভাবেই কাম্য নয়। এই ঘটনা চুয়েটের শিক্ষক সমাজের জন্য একটি কালো অধ্যায় হয়ে রইলো।
আমিনুল আরো বলেন, ঘটনার তিন মাসেও অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া চুয়েট প্রশাসনের মাদকবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি এবং প্রশাসনের সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মাদকের সাথে জড়িত ব্যক্তি যেই হোক, আমরা তার সঠিক বিচার চাই এবং মাদকমুক্ত চুয়েট ক্যাম্পাস চাই।
যন্ত্রকৌশল বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামিন ইয়াসির আবিদ বলেন, ছাত্র হলে গভীর রাতে দুইজন শিক্ষকের এমন আচরণ অত্যন্ত লজ্জাজনক। চুয়েট প্রশাসন মাদকের ব্যাপারে সর্বদা সোচ্চার। তবে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদানেই সীমাবদ্ধ। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বেলায় প্রশাসনের নিরব ভূমিকা আমাদের অবাক করেছে। ঘটনার ৩ মাসেও প্রশাসন উনাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় নি। আমরা চাই অতিদ্রুত যেন তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষক শাফকাত আর রুম্মান চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী এবং চুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। শিক্ষার্থী থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে সহপাঠীকে মারধর, শহীদ মোহাম্মদ শাহ হল ক্যান্টিনের কর্মচারীকে মারধর, মাদক গ্রহণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে।
এ বিষয়ে পুরকৌশল ও পরিবেশ অনুষদের ডিন সুদীপ কুমার পাল বলেন, তার বিষয়ে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকার ব্যাপারে আমি অবগত ছিলাম না। এ ঘটনার পর আমাদের একটি সভায় হলের প্রাধ্যক্ষরা হলে মারপিটে তার জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানান। বিভিন্ন বিষয়ে এর আগেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল, কিন্তু ঠিক কী কারণে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সেটা তখনকার উপাচার্য মহোদয় বলতে পারবেন। তবে বিষয়গুলো জানার পর আমরা এবারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে অনুরোধ করেছি যাতে উনারা স্বপ্রণোদিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে সবগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করেন। আমরা আশাবাদী তদন্ত কমিটি তথ্য উপাত্তসহ প্রতিবেদন দিলে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত এমন ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া অযৌক্তিক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে রেজাল্টকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। মোটাদাগে কারো পূর্বের কার্যকলাপকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এখানে আগে নিয়োগ দিয়ে পরে বিভিন্ন বিষয় যাচাই করা হয়। তবে এখন সময় এসেছে নিয়োগের ক্ষেত্রে একজনের অতীত কার্যকলাপকেও যাচাই-বাচাই করার। ফলে এরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেনা।
দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে কালক্ষেপন করা ঠিক নয়। উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে প্রতিবেদনের জন্য তাগদা দেয়া প্রয়োজন ছিল। আগামীকালই এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার ও কমিটির সদস্যদের সাথে কথা বলবো।
বিএনএনিউজ/ ইয়াসির/ বিএম/এইচমুন্নী