বিএনএ, ঢাকা : ১৯৭২ সালে প্রথম নিষিদ্ধ হয় দলটি। ১৯৭৬ সালে জিয়ার পলিটিক্যাল পার্টি রাইটসের মাধ্যমে রাজনীতি করার সুযোগ পায় স্বাধীনতার বিরোধীতাকারি দলটি। জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশের ৪৮ বছরের রাজনীতিতে জিয়া- এরশাদ- খালেদার সরাসরি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জামায়াত ইসলামী একটি ম্যাজিক্যাল পলিটিক্যাল পার্টি হিসাবে যুগ যুগ ধরে রাজনীতিতে শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মূল উপজীব্য ধর্ম, সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির সাংগঠনিক অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কোন অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর।
১৯৭৬ সালের ৩রা মে রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ওই সময় সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। এরপর জামায়াতে ইসলামীর আত্মপ্রকাশ করা ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু জামায়াত ইসলামী সাথে সাথে আত্মপ্রকাশ করেনি।
রাজনীতিতে তারা কিছুটা কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করে। যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধচারণ তখনো সবার মনে টাটকা ছিল, সেজন্য দলটি তাৎক্ষনিকভাবে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল বেছে নেয়।
ছিয়াত্তর সালের ২৪শে আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং আরো কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আই.ডি.এল) নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এই দলটির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেন।
ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছয়টি আসনে জয়লাভ করেন।
সে নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে প্রথমবারের মতো আসেন। সে বছরই জামায়াতে ইসলামীর একটি কনভেনশন আহবান করা হয়।
১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ এবং ২৭ মে ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। আব্বাস আলী খানের আহবানে সে কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন প্রায় সাড়ে চারশো জন সদস্য। কনভেনশনে গোলাম আযমের একটি ভাষণ পড়ে শোনানো হয়।
এই সম্মেলনে একটি নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। ১৯৭৯ সালের ২৭শে মে চার দফা কর্মসূচী নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে কর্মতৎপরতা শুরু করে।
এরপর থেকে জামায়াতে ইসলামী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশও করেছে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক তৎপরতা প্রকাশ্যে ছিল।
আন্দোলন সামাল দেওয়ার জন্য জেনারেল এইচএম এরশাদ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনায় বসেন। সে সময় জামায়াতে ইসলামীকেও আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন জেনারেল এরশাদ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ছিলেন গোলাম আযম।
উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ২২শে নভেম্বর ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান চলে যান।
১৯৭৮ সালে গোলাম আজম পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে। তবে তিনি আর ফিরে যাননি।
স্বাধীন বাংলাদেশে গোলাম আযম ১৯৮১ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসেন।
ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে সেখানেই প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন।
নাগরিকত্ব না থাকার পরেও জামায়াতে ইসলামী চলতো গোলাম আযমের নির্দেশনায়।
“১৯৭৮ সনে দেশে ফেরার পর থেকে অধ্যাপক গোলাম আযম বারবার আমীরে জামায়াত নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। তার নাগরিকত্ব ছিলো না বিধায় রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা পালন করতেন ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান।”
সে ধারাবাহিকতায় ১৯৯২-৯৪ সালের জন্য জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন গোলাম আযম।
জামায়াতে ইসলামী তখন গোলাম আযমের নাম প্রকাশ্যে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
নাজির আহমেদ লিখেছেন, ”এই নির্বাচনে অধ্যাপক গোলাম আযম আমীরে জামায়াতে নির্বাচিত হলে তাঁর নাম প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হবে কিনা বিষয়টি কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও শেষে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায় আলোচিত হয়। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে এবার প্রকাশ্যে নাম ঘোষণা করা হবে।”
যখন গোলাম আযমকে জামায়াতের প্রকাশ্য আমীর ঘোষণা করা হয়, তখন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বড় ধরণের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনের মুখে নাগরিকত্বের প্রশ্নে গোলাম আযমকে জেলে যেতে হয়েছিল।
জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে জামায়াতে ইসলামী ১৮ টি আসনে জয়লাভ করে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী সমর্থন না দিলে বিএনপির পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হতো না। তখন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে জামায়াতে ইসলামী।
জেনারেল এরশাদের পতনের পর উনিশশো একানব্বই সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বেশি আসন পেলেও সরকার গঠনের জন্য অন্য দলের সমর্থন প্রয়োজন ছিল, আর সমর্থনের বিনিময়ে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে এক অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম/ হাসনা