বিএনএ, ডেস্ক : ২০১৬তে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাগলাটে এক নেতাকে নিজেদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন আমেরিকার জনগণ। তবে ভোটের পর গুঞ্জন আসে এই নেতাকে নাকি ক্ষমতায় বসিয়েছেন রুশ গোয়েন্দারা। পরে তদন্ত বসায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের সঙ্গে রুশ আঁতাতের বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেননি। পরে বন্ধ হয়ে যায় সেই আলোচনা। এবার ফের সেই ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসেছেন সাবেক এক কেজিবি কর্মকর্তা। তার দাবি ৪০ বছর ধরে চেষ্টার পর ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসাতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দি গার্ডিয়ানে এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস–এর প্রতিনিধি হিসেবে গত শতকের আশির দশকে কাজ করতেন ইউরি শভেৎস। সম্প্রতি তার বরাত দিয়ে মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক ক্রেগ আঙ্গার লিখেছেন একটি বই; নাম আমেরিকান কমপ্রোম্যাট। বইটিতে উঠে এসেছে ট্রাম্পের হাঁড়ির খবর।
এতে জানানো হয়েছে, ইউরি শভেৎসের সাংবাদিক পরিচয় আসলে ছিল ছদ্মবেশ। আসলে তিনি মেজর পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির হয়ে। সোভিয়েতের পতনের পর ১৯৯৩ সালে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে তিনি থাকেন ভার্জিনিয়ায়। পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও। ৬৭ বছর বয়সী ইউরি শভেৎস বর্তমানে বাণিজ্যিক নিরাপত্তা তদন্তকারী হিসেবে কাজ করছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬০র পর থেকেই কেজিবি গোয়েন্দাদের একটি কৌশল ছিল সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী অথবা তরুণদের লক্ষ্যবস্তু বানানো। একসময় এই তরুণেরাই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছান। ট্রাম্পের বিষয়টি এই কৌশলেরই একটি উদাহরণ। এমন সময়েই ১৯৭৭ সালে চেক মডেল ইভানা জেলনিকোভা বিয়ে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেসময়ই রাশিয়ার গোয়েন্দাদের নজরে পড়েছিলেন তিনি।
আমেরিকান কমপ্রোম্যাট বইতে মার্কিন সাময়িকী ভ্যানিটি ফেয়ার–এর সাবেক কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ক্রেগ আঙ্গার লিখেছেন, ট্রাম্প রুশ গোয়েন্দাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার পর চেকস্লোভাকিয়া ও কেজিবি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তাঁকে নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৭৭ সালে প্রথম বিয়ের তিন বছর পর ট্রাম্প তাঁর আবাসন ব্যবসায় প্রথম বড় কাজে হাত দেন। নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে গ্র্যান্ড হায়াত নিউইয়র্ক হোটেল। এই হোটেলের জন্য সেমইয়ন কিসলিন নামের এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০টি টেলিভিশন সেট কিনেছিলেন ট্রাম্প। রুশ নাগরিক কিসলিন তখন নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউর জয়–লুড ইলেকট্রনিকসের মালিকদের একজন ছিলেন।
এতে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে ট্রাম্প ও ইভানা প্রথমবারের মতো মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ ভ্রমণ করেন। ইউরি শভেৎসের দাবি, সেখানে কেজিবির গোয়েন্দাদের কথার জাদুতে মজে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই গোয়েন্দারাই প্রথম তাঁর মাথায় রাজনীতির বুদ্ধিটা ঢুকিয়ে দেয়।
ইউরি শভেৎসের দাবি, জয়–লুড নিয়ন্ত্রণ করতেন কেজিবি। আর কিসলিন ছিলেন এই গোয়েন্দা সংস্থার স্থানীয় এজেন্ট। তাঁর কাজ ছিল কেজিবির টোপ গিলতে পারে এমন মানুষ শনাক্ত করা। উদীয়মান তরুণ ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে কিসলিনই শনাক্ত করেছিলেন। কেজিবিও তাঁকে সম্ভাবনাময় বলে মেনে নিয়েছিল।
কেজিবির সাবেক মেজর ইউরি শভেৎস স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘কেজিবি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ট্রাম্প অত্যন্ত নাজুক ছিলেন। তিনি তোষামোদ পছন্দ করতেন। এই বিষয়টিই কাজে লাগায় কেজিবি। গোয়েন্দারা এমন একটা ভাব ধরলেন, যেন ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত। তাঁর মতো মানুষেরাই বিশ্বটাকে বদলে দিতে পারেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেজিবির এই খেলায় ট্রাম্প এতটাই মজে গিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেই রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। এমনকি নিউ হ্যাম্পশায়ারে পোর্টসমাউথে তিনি একটি সমাবেশও করলেন। ১৯৮৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও বোস্টন গ্লোব–এর মতো সংবাদপত্রে পুরো পাতায় বিজ্ঞাপন দিলেন। এই বিজ্ঞাপনে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরেন। এ ছাড়া এতে জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে শোষণের অভিযোগও তোলেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের থাকা নিয়েও দ্বিমত পোষণ করেন।
ওই বিজ্ঞাপন প্রকাশের কিছুদিন পর কেজিবির সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইউরি শভেৎস দেশে ফিরে যান। এর পরপরই তিনি কেজিবির ফার্স্ট চিফ ডিরেক্টরেটের সদর দপ্তরে যান। বিদেশের মাটিতে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের দায়িত্ব ছিল এই দপ্তরের ওপর। সেখানেই ইউরি একটি গোপন তারবার্তা পান, যাতে ট্রাম্পের বিজ্ঞাপন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।
ইউরির ভাষ্যমতে, ‘ঘটনাটি ছিল অভূতপূর্ব। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। সে সময় আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি যে কেউ নিজের নামে এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে এবং পশ্চিমা দেশটির মানুষেরা তা মেনেও নেবে। কিন্তু ঘটনা সেটাই ঘটেছে। ট্রাম্প ঠিকই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয় মস্কোয় যেন উৎসবের আমেজ তৈরি করেছিল। যদিও বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের সঙ্গে রুশ আঁতাতের বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেননি। কিন্তু সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস অ্যাকশন ফান্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঠিকই নিজেদের অনুসন্ধানে ট্রাম্পের প্রচারশিবির ও অন্তর্বর্তী দলের কমপক্ষে ২৭২ জনের রুশ–সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছিল। এ ছাড়া রুশ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ট্রাম্প শিবিরের বিভিন্ন সদস্যের কমপক্ষে ৩৮টি বৈঠকের তথ্যও তারা পেয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘ট্রাম্প ছিলেন একটা সম্পদ। তবে বিষয়টা এমন নয় যে কেজিবি তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমরা এই লোককে গড়ে তুলব এবং ৪০ বছর পর তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন। আশির দশকের যে সময় বিষয়টি শুরু হয়েছিল, তখন কেজিবি পাগলাটে লোকদেরই লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছিল। এবং ট্রাম্পের মতো আরও অনেকের পেছনেই ছুটছিল তারা। তবে নানা দিক থেকেই ট্রাম্প ছিল তাদের নির্ভুল লক্ষ্য। ২০১৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ের আগপর্যন্ত তাঁর পেছনে লেগেই ছিলেন রুশ গোয়েন্দারা।’