বিএনএ, ডেস্ক : সনাতন জাগরণ মঞ্চের মূখপাত্র চিন্ময় দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় কারাগারে আটক রাখা এবং ইসকন ইস্যুতে ভারত- বাংলাদেশ এখন মুখোমুখি। দুই দেশের সরকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিছিল, মিটিং থেকে হুমকি, পাল্টা হুমকি, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সর্ম্পক তলানিতে ঠেকেছে। যা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই প্রথম।
গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হিন্দুদের ওপর হামলা নির্যাতনে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উপদেস্টা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থক এবং ইসলামী দল গুলোর বিভিন্ন মন্তব্য ও মনোভাবের কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের বৈরিতা চলে আসছে। সম্প্রতি সনাতন জাগরণ মঞ্চের মূখপাত্র চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার ও জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণ এবং সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে একজন রাষ্ট্রপক্ষের সহকারি পাবলিক প্রসিকিউটরকে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে হিন্দু মুসলিম একটি বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের অভিযোগ ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নানাভাবে নিপীড়ন করছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির ওপর ভারত গভীরভাবে নজর রাখছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার অভিযোগ এনে ভারতের লোকসভায় করা পাঁচটি প্রশ্নের লিখিত জবাবে এসব কথা বলেন এস জয়শঙ্কর। শুক্রবার ওই প্রশ্নোত্তরগুলো প্রকাশ করেছে লোকসভা।
প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশজুড়ে চলতি বছরের আগস্টসহ বিভিন্ন সময়ে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর সহিংসতার খবর দেখেছে ভারত সরকার। তাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ধর্মীয় স্থানগুলোতেও হামলার খবর পাওয়া গেছে। ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ভারত। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
শুক্রবার আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন ভারতের নিজের মাটিতে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ সেটা নিয়ে তাদের সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। ভারতের এই দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর।
আইন উপদেষ্টা ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার বরাত দিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে।
‘আমরা নিজেরাও দেখেছি, ছাত্রসংগঠন, মাদ্রাসা, রাজনৈতিক দলসহ বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার সময় কীভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছে। সর্বশেষে চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নির্মম ও উসকানিমূলকভাবে হত্যার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা অসীম সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।’ লিখেছেন আসিফ নজরুল।
এ দিকে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের সামনে বঙ্গ হিন্দু জাগরণ নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। এই ঘটনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের কুটনৈতিক সর্ম্পকের উষ্ণতার পারদ যখন ঊধ্বমূখী উদ্ধমূখী তখন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মামুনুল হক। শুক্রবার বাদ জুমা ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রাজপথে নামবে। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে মানুষ বাধ্য হবে। ভারত যদি এখনো বাংলাদেশের মানুষের “পালস” বুঝতে ব্যর্থ হয়, বাংলাদেশের মানুষের বিপ্লবকে, ক্ষমতাকে নেগলেট করার চেষ্টা করে, অসম্মান করার চেষ্টা করে, তাহলে ভারত “খান খান” হয়ে যাবে।’
প্রতিবেশী কোনো দেশের সঙ্গে ভারত সুসম্পর্ক রক্ষা করতে পারেনি, উল্লেখ করে হেফাজতের এই নেতা বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ভারত সার্ক থেকে একঘরে হয়ে গেছে। তাদের পাশে কোনো দেশ নেই। চারপাশ থেকে ক্ষুদ্র শক্তিগুলো হাত–পা, নাক চেপে ধরলে তারা দম নিতে পারবে না।
মামুনুল হক অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ভারতের নির্দেশনায় দেশের ভেতরে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়েছেন।
ইসকনকে ‘সন্ত্রাসী–জঙ্গি সংগঠন’ উল্লেখ করে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যদি এই দাবি আদায়ে সরকার অথবা বিচার বিভাগ গড়িমসি করে, তাহলে হেফাজতে ইসলাম বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।
একইদিন শুক্রবার নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘উগ্র বক্তব্যের ঢেউ, সহিংসতা ও উসকানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। এসব বিষয় শুধু মিডিয়ার অতিরঞ্জন হিসেবে খারিজ করা যায় না।’
জয়সোয়াল বলেন, হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু যেসব হুমকি পাচ্ছেন এবং তাদের নিশানা করে সংঘটিত হামলার বিষয়গুলো ভারত ধারাবাহিকভাবে ও শক্ত করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরছে।
‘এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সব সংখ্যালঘুকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ বলেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ।
ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে পারে বলে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জয়সোয়াল বলেন, ‘এটা যখন হয়, তখন আপনাদের জানানো হবে।’
জয়সোয়ালের এমন জবাবকে ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে ডিসেম্বরে যে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তা অনিশ্চিত বলে মনে করছেন কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সৈয়দ সাকিব