ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। বর্তমানে ঝিনাইদহ সংসদীয় আসন ৪ (কালীগঞ্জ ) সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলায় কারাগারে আটক রয়েছে। মিন্টুর সঙ্গে আনারের বিরোধ ২০০৪ সাল থেকে। যা গত বছরে জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সামনে এনেছে সাইদুল করিম মিন্টু।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে মিন্টুই সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ প্রকাশ গ্যাস বাবুকে এসাইনমেন্ট দিয়েছিল। এ জন্য ২ কোটি টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। অগ্রীম হিসাবে দেওয়া হয় ২০ লাখ টাকা। গ্যাস বাবু চরমপন্থী নেতা আমানউল্লাহ প্রকাশ শিমুল ভূইয়াকে ভাড়া করে। শিমুল ভূইয়া তার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে নিয়ে একটি নীল নকশা করে। এই জন্য আনারের বন্ধু শাহীনের সহযোগীতা চায় শিমুল ভূইয়া। শাহীন আনারের ভালো বন্ধু হলেও সোনা পাচারের কমিশন নিয়ে ভিতরে ভিতরে বিরোধ ছিল। সোনা ব্যবসা ও শিলাস্তিকে দিয়ে হানি ট্র্যাপের মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে সংসদ সদস্য আনারকে শাহীনের ফ্ল্যাটে নেয়।
প্রসঙ্গত. ১৮ জানুয়ারি তাকে কলকাতায় গাড়িতে হত্যা করে লাশ বর্জ্যখালে ফেলে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল । কিন্তু সেই দিন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতায় যাননি। তিনি গিয়েছেন তারপরদিন ১৯ জানুয়ারি। ফলে ওই সময় তাকে হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে কৌশলে ফ্ল্যাটে নিয়ে হত্যার নতুন ছক কষে খুনি চক্র। তারই অংশ হিসাবে শাহীন কলকাতার নিউটাউনের সন্জীবা গার্ডেনে যুক্তরাষ্টের নাগরিক হিসাবে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। শাহীনের সঙ্গে সাইদুল করিম মিন্টুরও সুসর্ম্পক ছিল। সেটি কাজে লাগিয়েছে শিমুল ভূইয়ার মাধ্যমে গ্যাস বাবু।
যার কারণে আনারকে হত্যার পর শিমুল ও গ্যাস বাবু ছবি ও মেসেজ বিনিময় করেছে। এইসব ছবি ও মেসেজ ফরিদপুরের ভাঙ্গায় গিয়ে গ্যাস বাবুর মোবাইল থেকে দেখেছে সাইদুল করিম মিন্টু। শিমূল ভূইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর মিন্টুর পরার্মশে গ্যাস বাবু তার তিনটি মোবাইল ফোন ঝিনাইদহের দুইটি পুকুরে ফেলে দেয় এবং হারিয়ে গেছে মর্মে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
পরবর্তীতে শিমুল ভূইয়ার জবানবন্দির ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হয় গ্যাস বাবু। আর গ্যাস বাবুর জবানবন্দির ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হয় মিস্টার ঝিনাইদহ খ্যাত ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। তার গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার মোটিভ ব্যবসায়িক বিরোধের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধও যুক্ত হয়।
যদিও সাইদুল করিম মিন্টু আদালতে দাবি করেছেন তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঝিনাইদহ ৪ সংসদীয় আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলেই সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যায় তাকে জড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার অনুসারি ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছেন ভিন্ন কথা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইদুল করিম জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগের আর্দশের অনুসারি। তার জন্ম ১৯৬৪ সালের ২ জুন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার জোড়াদাহ ইউনিয়নের ভায়না বিশ্বাসপাড়া গ্রামে। তার পিতা রুহুল কুদ্দুস ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান রুহুল কুদ্দুস। বাবা রুহুল কুদ্দুস মারা যাওয়ার পর অনেক অভাব-অনটনে পড়তে হয় মিন্টুর পরিবারকে।
১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ভারমুক্ত হয়ে পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৭ সালে ছাত্রলীগের সক্রিয় সাবেক কর্মীদের নিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। ১৯৮৯ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১১ সালের ১৩ মার্চ ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাচনে সাইদুল করিম মেয়র নির্বাচিত হন। আইনগত জটিলতায় নির্বাচন না হওয়ায় এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর তিনি এই পদে ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এ ছাড়া ঝিনাইদহ ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও ঝিনাইদহ চক্ষু হাসপাতালের সভাপতি মিন্টু। ঝিনাইদহের অনেক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন তিনি। বর্তমানে ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর ইন্দিরা সড়কের বাড়িতে স্ত্রী আর্মিজা শিরিন আক্তার ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন। স্ত্রী আর্মিজা শিরিন আক্তার স্থানীয় একটি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং সাইদুল করিম সেই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। ঠিকাদারি সহ নানা ব্যবসা- বাণিজ্যের মাধ্যমে এখন বিপুল সম্পদের মালিক সাইদুল করিম মিন্টু।
ত্যাগী, পোড় খাওয়া রাজনীতিক সাইদুল করিম কী আদৌ সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম হত্যাকান্ডের অর্থ যোগানদাতা বা মাস্টার মাইন্ড কীনা তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। অপরাধ পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন, শাহীনের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং মিন্টুর রাজনৈতিক স্বার্থের যোগসূত্রে দেশের বাহিরে প্রথমবারের মতো একজন সংসদ সদস্য পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা চাপ না থাকলে সাইদুল করিম মিন্টু সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকান্ডে বেনিফিশারি হতে চেয়েছিলেন কীনা তা কিছুদিনের মধ্যে খোলাসা হয়ে যাবে।
সৈয়দ সাকিব/ হাসনা