বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খন্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভান্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে। ১ মার্চ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেপথ্যে গণ মাধ্যমের ভূমিকা, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের।
আজ(৩০ মার্চ২০২২) প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৩০
১৫ জুলাই, ১৯৭১
…..পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য দেয়ার মতো আদৌ কোন অবস্থা রয়েছে কিনা তা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যে বিশ্বব্যাঙ্কের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে ফিরে গিয়ে তাঁরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন।
এই রিপোর্টে বলা হয় : বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে এসে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদল তাঁদের রিপোর্টে এই একমাত্র সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করা হোক। কারণ, এখন পাকিস্তানে যে কোন আন্তর্জাতিক সাহায্যই দেয়া হোক না কেন তা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।
রিপোর্টে তাঁরা বলেছেন : বর্তমানে পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যাবেনা। এমনকি পাকবাহিনী বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্যে যদি কোন আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানো হয় তাহলে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার সেই সাহায্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোন সাহায্যই পৌঁছাবে না। বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানকে কোন রকমের আন্তর্জাতিক সাহায্য দিলে ইয়াহিয়া সরকার তা পশ্চিম পাকিস্তানেই পাচার করবে। অতএব পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যেতে পারেনা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফরকারী বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদলের নেতা Mr. I.P.M. CARGILL এই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন। Mr. I.P.M. CARGILL বিশ্বব্যাঙ্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর।
Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের ব্যাপকতা এত বেশী হয়েছে যে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক জীবনধারা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের বিরুদ্ধে যে এখনও সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে, সেখানকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তারা যে এখনও চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, হত্যা, লুন্ঠন ও ব্যাভিচারে তারা যে এখনও সমান তৎপর রয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই হোক অথবা বিশেষ ব্যাক্তিবর্গের বিরুদ্ধেই হোক সামরিক প্রশাসকরা এখনও যেসব সামরিক তৎপরতা চালাচ্ছে তা বাংলাদেশের বৃহৎ জনসমষ্টির জীবনে এনে দিয়েছে এক গভীর আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। মুক্তিসেনাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাচ্ছে পাক সেনারা, আর তারই প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করেছে সাধারণ মানুষের উপর।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন দারুণ উদ্বেগজনক। স্বাভাবিকতার নাম-গন্ধ নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে পাকিস্তানী সামরিক সরকার যে দাবী করছে Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে তার কঠোর সমালোচনা করে বলেন : সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, সৈন্য প্রত্যাহার করা ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে না।
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র – ৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৬৬-৬৭) চলবে।
পড়ুন আগের পর্ব সমূহ:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-২৪
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা