আমি একলা থাকি, আমার সামনেই পাক হয় । আমার সহকর্মীরা কি অন্যায় করেছে, কেউ কি জেলের আইন ভেঙেছে যে এক জায়গায় থাকতে পারেন না, আর একসাথে পাক হতে পারে না? এদের কাউকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। এক সাথে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করলে আপনাদের কি ক্ষতি হয়? আমার মনের অবস্থাও খারাপ, মা অসুস্থ। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। বহুলোককে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে । আমি এই অবস্থায় একলা থাকলে শরীর ভেঙে পড়বে।’ তার একই উত্তর, তাদের হাতে কিছুই নাই । উপর থেকে যা হুকুম আসে তাদের তাই করতে হয়। অন্য কোনো রাজবন্দিদের বা ডিপিআরদের বেলায় বোধ হয় উপরের হুকুম আসে না-কোথায় কাকে রাখতে হবে! শুধু কি আওয়ামী লীগারদের বেলায় এই অন্যায় ব্যবস্থা ! তিনি বললেন জেলের ডিআইজি সাহেবকে তিনি বলবেন। তিনি কিছু করতে পারেন না, তার হাতে কিছুই নাই ।
তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম সত্যই তাদের হাতে কিছুই নাই । কয়েদিদের কোথায় রাখা হবে জেল কর্তৃপক্ষ জানেন না। তবে দায়িত্ব তাদের । কোনো কিছু গোলমাল হলে এরাই আবার দায়ী হবে ।
জেলার সাহেব ও ডিপুটি জেলার সাহেব চলে গেলেন । আমি গোসল করে খেতে বসেছি, দেখি ইলিশ মাছ, নারিকেল দিয়ে পাক করেছে। জিজ্ঞাস করলাম এটা আবার কি? এ তো কোনোদিন খাই নাই, এ আবার কেমন? বাবুর্চি বললো, একজন বলেছিল তাই পাকালাম । বললাম আমিতো এখানেই ছিলাম। জিজ্ঞাস করলেই ভাল হতো । যাহা হউক, কিছু খেয়ে কাগজ নিয়ে শুয়ে পড়লাম । কাগজ পড়তে পড়তে ঘুম আসে, কিন্তু ঘুমাতে চাই না। দিনে ঘুমালে রাতে তা হলে আর ঘুমাতে পারব না।
সর্বনাশ! ট্রেন দুর্ঘটনায় বহুলোক মারা গেছে। অনেক জখম হয়েছে। এখনও পুরা খবর পাওয়া যায় নাই। দুর্ঘটনা কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে হয়েছে ব্রিটিশ আমলের লাইন । সেখানে একটু খারাপ হলে মেরামত করা হয় । পুরাপুরি এর একটা মেরামত হওয়া প্রয়োজন । কে খেয়াল করে! পূর্ব বাংলার রেলওয়ের দুরবস্থা আমার খুব জানা আছে। ট্রেনে চড়ে বহু ভ্রমণ আমি করেছি দুই চারটি নতুন ট্রেন ছাড়া আর সকলগুলিই ব্রিটিশ আমলের । এমন কোনো ট্রেন নাই যাতে বৃষ্টি নামলে পানি পড়ে না। তবে পানি যখন ট্রেনে পাওয়া যায় না, তখন খোদার পানি পড়তেই বা আপত্তি কি! কিছুদিন পূর্বে যখন আমাকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় তখন এক ফার্স্ট ক্লাসে আমি ছিলাম, দুই পুলিশ ইন্সপেক্টারও ছিলেন । হঠাৎ বৃষ্টি হলো, আমরা অনেক কষ্টে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সমস্ত কামরাটি ভিজে গেল বললাম চলুন অন্য ঘরে যাওয়া যাক। তারাও আমার সাথে পাশের ঘরে এসে আশ্রয় নিল। সেখানেও পানি পড়ে, তবে একটু অল্প পরিমাণে।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮১-৮২, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী