গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৬ বছরের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পায় বিএনপি। এই পটপরিবর্তনে ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই।
একদিকে তৃণমূলের একটি অংশ দখল, আধিপত্য বিস্তারসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এবং নির্বাচনের সময় নিয়ে অস্পষ্টতায় অর্ন্তবতীকালীন সরকারের সমালোচনা করছে দলটির নেতারা।
অর্ন্তবতীকালীন সরকারকে নিয়ে চরম সংকটে রয়েছে বিএনপি। যদিও শুরু থেকে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। আর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন, সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য এবং ভোটার তালিকা প্রস্তুত হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। জামায়াত ইসলামী, জাতীয়পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন ইসলামী দল সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করলেও বিএনপি পরোক্ষভাবে তার বিরোধীতা করেছে।
বিএনপি নির্বাচন ও সংস্কারের জন্য এত লম্বা সময় দিতে নারাজ। সময়ের প্রশ্নে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে কিছুটা উদ্বেগ ও অসন্তুষ্টি আছে। বিএনপি কার্যত যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন চাইছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এতেও অসন্তুষ্টি আছে বিএনপির। দলটি আশা করেছিল, কমিশন গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সরকার প্রস্তাব চাইবে।এরই মধ্যে ছয় কমিশন বলেছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেবে।
সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে সময় কমিয়ে আনতে এবং জটিলতা এড়াতে বিএনপি দুই বছর আগে দেওয়া তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি সামনে এনে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনাও করছে। এই প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে বিএনপি ইতিমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে, বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে পৃথক মতবিনিময়ও করেছে। বিএনপি বলছে, তারা ভোটে নির্বাচিত হলে আন্দোলনকারী দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার করে সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে।
এ ছাড়া পটপরিবর্তনের পরও যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার ব্যাপারে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এ দুই বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা।
বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথা বললেও কার্যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় তারা। বিএনপির নেতারা মনে করেন, নির্বাচন যত পেছাবে, তাতে ভোটের মাঠে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব চাপও দিতে পারছে না। কারণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার শেষে তারপরই নির্বাচন করার পক্ষে জনমত বেশি।
যদিও মির্জা ফখরুল বলেছেন, মৌলিক পরিবর্তনগুলো করবে সংসদ। আমি মনে করি না এগুলোর জন্য বেশি সময়ের দরকার আছে। বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, বিএনপির এই মূহুর্তের প্রতিপক্ষ একসময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা দখল, চাঁদাবাজি ও হাঙ্গামায় বিএনপিকে দায়ি করছেন। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত বিএনপির নতুন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে কি না, তা নিয়েও দলটির ভেতরে-বাহিরে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এর ইঙ্গিতও মেলে।
৪ সেপ্টেম্বর দলের এক ঘরোয়া কর্মসূচিতে তারেক রহমান ‘সাম্প্রতিক সময়ের গজিয়ে ওঠা অদৃশ্য প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কৌশল প্রয়োগ করতে’ নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তিনি এই ‘অদৃশ্য প্রতিপক্ষ’ বলে জামায়াতকে ইঙ্গিত করেছেন।
যদিও এমন ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের সূত্রপাত করে জামায়াত। ২৬ আগস্ট এক বক্তব্যে দলের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখনো শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, রক্তের দাগ মোছেনি। বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না। তখন জামায়াতের আমির এমনও বলেন, ‘বিএনপি তো ইতিমধ্যে ক্ষমতার ৮০ ভাগ দখল করেই ফেলেছে। ভিক্ষুকের থালা থেকে হাটবাজার কিছুই বাকি রাখেনি।’ তাঁর এমন মন্তব্য প্রকাশ পেলে বিএনপিতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই মূহুর্তে জামায়াত নিজেদের একটি ‘বিকল্প’ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছে। তারই ধারাবাহিতায় দলটি সারাদেশে বড় বড় সাংগঠনিক সমাবেশ করে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে প্রতিপক্ষ হিসাবে নিয়ে দল গোছানের কাজ করে যাচ্ছে অর্ন্তবতীকালীন সরকারের ছায়ায়। আর বিএনপি চেয়ে চেয়ে দেখছে!
শামীমা চৌধুরী শাম্মী