বিএনএ, চট্টগ্রাম: নাম আবু সাদেক। বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। বান্দরবান সরকারি কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। আওয়ামী সরকারী আমলে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন এই শিক্ষার্থী। আবু সাদেক তাঁর গুম হওয়ার আড়াই মাস ও দেড় বছর কারাবাসের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জানান।
জানা যায়, এই শিক্ষার্থী ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় ফুফাতো ভাইয়ের দোকানে চাকরি করতে যায়। ওই বছরের ২৬ জুলাই দোকান থেকে আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গুম করে রাখা হয় ৭৬দিন। এর পর মিথ্যা মামলা দিয়ে ১৮ মাস কারাবাস।
আবু সাদেক বলেন, আমাকে একটি কালো মাইক্রোবাসে তুলে রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গাড়িতে যারা ছিল সবার কাছে অস্ত্র ছিল। আমাকে নিয়ে গাড়িটি চলতে থাকে। গাড়ি চলতে চলতে তারা আমার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। ২ ঘন্টার মতো সময়ের পথ পাড়ি দেয়ার পর তারা গাড়ি থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ হাটানোর পর আমাকে একটা রুমে নিয়ে যায়, তারপর চোখ খুলে দেয়। রুমে এসি, চেয়ার, বেড এবং জানালাবিহীন একটি লকআপ ছিল। দেওয়ালে লেখা ছিল গুম হওয়া ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার। বাথরুমে যাওয়ার সময় চোখ বেঁধে নিয়ে যেতো। বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে দিতো না। সিভিলে ২ জন পাহারায় থাকতো। একদিন রাতে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলে আমি নাকি বোমা হামলা চালিয়েছি। আমি ওনাদের বলি আমাকে কেনো নিয়ে আসছেন, আমি এসবের সাথে জড়িত না। তারা বলে যেটা বলবো সেটা করবি না হয় মেরে ফেলবো। এটি হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।একজন পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে এটা পরে জানতে পারি ।
এই শিক্ষার্থী আরও জানায়, পরদিন আমাকে খুব সকালে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ হতে বলে। আমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করি। নাস্তা দেয় একটি মাম পানি, পাউরুটি ও কলা। আমাকে চোখ বেঁধে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় ৩ ঘন্টা গাড়িতে অবস্থান করি। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে যমুনা সেতু দেখবে কি না! আমি চুপ থাকি। তারা চোখ খুলে দিলে দেখি যমুনা সেতু। তখন মনে করি, আমি এতক্ষণ ঢাকায় ছিলাম এখন উত্তরবঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর আরও এক থেকে দুই ঘন্টা গাড়ি চলে। তারা চোখ বাঁধার সময় একটু হালকা করে বেঁধেছিল তখন আমি একটু একটু দেখতে পাই। পরে দেখি বগুড়া থানার সাইনবোর্ড। তখন আমি নিশ্চিত যে বগুড়া থানায় অবস্থান করতেছি।
তিনি বলেন, আমাকে একটি ভবনে নিয়ে যায়। ভবনের উপরে লেখা ছিল ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার। একটি রুমে আমাকে বসিয়ে রাখে কিছুক্ষণ। পরে চোখ খুলে দেয়। তখন দেখি ছোট ছোট আয়না ঘর। একটি আয়না ঘরে আমাকে নিয়ে যায়। ওখানে ছিল একটি লোহার সিট। সিটের সাথে বাঁধা ২টি হ্যান্ডকাপ। একটির সাথে আরেকটি জোড়া লাগানো। একটি সিটের সাথে আরেকটি আমার হাতে বাঁধে। নামাজ পড়ার সময়ও হ্যান্ডকাপ খুলে দিতো না। একহাত বুকে দিয়ে নামাজ আদায় করা লাগতো, অন্য হাত হ্যান্ডকাপের সাথে ঝুলে থাকতো। এমনকি ঘুমানোর সময়ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে রাখতো। বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে নিয়ে যেতো।’
’’সেখানে আমাকে টানা তিনদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে একজন অফিসার এসে। সে প্রমাণ করতে চায় আমি একটি হামলায় ছিলাম। আমার সব কিছুর এড্রেস নেয়। অফিসাররা সিভিলে থাকতো। আর বাকিরা বাহিনীর পোশাকে। কিন্তু নামের ব্যাজটা খুলে রাখতো। তাদের রেঞ্জ লেখা ছিলো রাজশাহী। পরে আমাকে ওখানে ২ মাস ১৬ দিন আটক করে রাখা হয়। তারা আমাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতো।
আবু সাদেক বলেন, ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর মাগরিবের পর একটা লোক এসে বলে রেডি হও। আমি রেডি হওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে ওই ভবন থেকে বের করে একটি গাড়িতে তুলে। প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা পর গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার অন্য গাড়িতে তুলে। পরে ওই গাড়িতে আমার নাম জিজ্ঞেস করে। গাড়ি আরো ৩ থেকে ৪ ঘন্টা চলে। এরপর আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উপরে তুলে। চোখ খুলে দেখি সকাল হয়েছে। পরে নাস্তা দেয়। পরদিন ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার পর দেখি একজন অফিসার এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তারা আমার বয়স নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। যদিও তখন আমার বয়স ছিল ১৬। তখন আমাকে বয়স ১৯ বলতে বলে। ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর ২নং গেইট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষা ছিলো। আমি নাকি ওইদিন বোমা হামলা করেছি এটা স্বীকার করতে বলে পুলিশ। আর গুম থাকা বিষয়টি কখনো কাউকে না বলতে বলে। বললে মেরে ফেলবে। এটা ছিল চট্টগ্রামের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি সাইনবোর্ডের সামনে নিয়ে গিয়ে পিছনে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আমিসহ মোট ৬ জনকে ছবি তুলে। পরে চট্টগ্রাম আদালতে নিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন আমাকে নিয়ে আসছে। আমি সব সত্য কথা বলি এবং জানাই আমার বয়স ১৬। আমি হামলার সাথে জড়িত ছিলাম না এটাও বলি। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করেননি। মামলাটি শিশু আইনে নিয়ে যায়। পুলিশ আমার একদিনের রিমান্ড চাইলেও আদালত তা নামঞ্জুর করে আমাকে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করে। ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর আমাকে টংঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। প্রায় ৯ মাস ধরে জামিন হচ্ছিল না। পরে একদিন হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছি বলে জানতে পারি। কিন্তু জামিনের কাগজ আসতে দেরি হচ্ছিল। পরে কারাগারে থাকাকালীন শুনি আমার নামে গাজীপুর বাসন থানায় আরো একটি মামলা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই গাজীপুর আদালতে নিয়ে যায়। এরপর আমার ২ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত না মঞ্জুর করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে জিজ্ঞেসাবাদ করতে বলে। পরদিন এন্টি টেরোরিজম ইউনিট জিঙ্গাসাবাদ করতে আসে। নাম এবং কেন জেলে গেছি এসব জিজ্ঞেস করে। আরো অনেকের নাম বলে তাদের চিনি কি না, এরপর তারা চলে যায়। এর পর আরও ৯ মাস ২৪ দিন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকি। অবশেষে ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল জামিন পাই হাইকোর্ট থেকে। দীর্ঘ ১৮ মাস ৪ দিন কারাবরণ করি। গুমসহ ২০ মাস ২০ দিন। আমি নির্দোষ! আমার জীবন থেকে ২০ মাস ২০ দিন চলে গেলো। আর দুইটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা। মামলার এজাহারেও নাম ছিল না। একটি চট্টগ্রাম আর একটি গাজীপুরের। আমার পক্ষে মামলাগুলো চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
আবু সাদেক প্রশ্ন করে বলেন, আমি যদি অন্যায় করি আমাকে গুম করলো কেন? ১৬ বছর বয়সকে ১৯ বছর করলো কেন? জেলে থাকাকালীন আরো একটি মামলা দিল কেন? নতুন বাংলাদেশে কি এটার বিচার হবে? তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সন্ত্রাসবিরোধী মামলা প্রত্যাহারসহ হয়রানির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন বান্দরবান সরকারি কলেজের এ শিক্ষার্থী।
বিএনএনিউজ/ নাবিদ/এইচমুন্নী