যারা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার কথা তারা এখন নিজেরাই সমৃদ্ধ। শুধু নিজে, স্ত্রী সন্তানদের মোটা তাজা করেই ক্ষান্ত হননি। মোটা তাজা করেছে শালা- শালী, শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ আত্মীয় স্বজনদের। এমনকি বাদ যায়নি ঘনিষ্ঠ পড়শিরাও। সম্প্রতি অবৈধ আয়ে মোটাতাজার এক কারিগরের সন্ধান পেয়েছে দূর্নীতি দমন কমিশন। তিনি হচ্ছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। থাকেন রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা খুলনার খান এ সবুর রোডের মুজগলি এলাকায়।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও বদলি বানিজ্য, আয়করদাতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ গ্রহণ, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অবৈধ অর্থ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি অবৈধ অর্থের প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করতে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর করেছেন।
বিএনপির আমলের চাকুরিতে যোগদানকারি মাহমুদ ফয়সাল আওয়ামী লীগ আমলে দূর্নীতির বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছেন। স্বনামে বেনামে গড়ে তুলেছেন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের জন্য নিজের নামসহ তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে ৭০০টির বেশি হিসাব খোলেন।দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এর প্রমাণ মিলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হওয়া এবং পরে তার বড় অংশ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে।
গত ২৭ শে জুন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফয়সাল, তাঁর স্ত্রী ও স্বজনদের ৮৭টি ব্যাংক হিসাব ও ১৫টি সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে ছয় কোটি ৯৬ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি ফয়সালসহ সাতজনের নামে থাকা ১৫টি সঞ্চয়পত্রে থাকা দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফয়সালের স্ত্রী আফসানাসহ চারজনের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে ডাচ বাংলা ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার দুটি সঞ্চয়পত্র, তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে চারটি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকা, আফতাব আলীর নামে দুটি সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ টাকা, কাজী খালিদ হাসানের নামে একটি সঞ্চয়পত্রে ৩০ লাখ টাকা, খন্দকার হাফিজুর রহমানের নামে দুটি সঞ্চয়পত্রে ৪০ লাখ টাকা, আহম্মেদ আলীর নামে তিনটি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকা ও মাহমুদা হাসানের একটি সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা রয়েছে।
ফয়সাল ছাড়া অন্য যাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ হয়েছে তাঁরা হলেন—শেখ নাসির উদ্দিন, মমতাজ বেগম, রওশন আরা খাতুন, আহম্মেদ আলী, খন্দকার হাফিজুর রহমান, ফারহানা আফরোজ, আশরাফ আলী মুনির, আফতাব আলী তানির, মাহফুজা আক্তার, মাইনুল হাসান, আফসানা জেসমিন, মাহমুদা হাসান ও কাজী খালিদ হাসান। এ ছাড়া স্থাবর সম্পদের মধ্যে আফসানা জেসমিনের নামে ১০ কাঠা জমি, ২০০ বর্গমিটারের প্লট, আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে ভাটারা, খিলগাঁও ও রূপগঞ্জে থাকা স্থাবর সম্পদ, আহমেদ আলীর নামে থাকা ফ্ল্যাট ও কার পার্কিংয়ের তিন হাজার ২২৮ বর্গফুট স্থাবর সম্পদ ও মমতাজ বেগমের নামে থাকা ১০ কাঠা জমি জব্দ করা হয়েছে।
আবু মাহমুদ ফয়সাল সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ ঘুষ লেনদেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের উদ্দেশ্যে শাহজালাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখায় তাঁর নিজ নামে বিভিন্ন এফডিআর হিসাব খোলেন। মেয়াদ পূর্তির পর এফডিআর ভাঙানো টাকা ও নতুন করে নগদ এনে ফারহানা আক্তার, মমতাজ বেগম, মাহমুদা হাসান, খন্দকার হাফিজুর রহমান, কারিমা খাতুনের নামে বিভিন্ন এফডিআর স্কিম খোলেন। পরে ওই অর্থ এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, লংকা-বাংলা ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স এবং সব শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শাখায় ওই লোকজন ছাড়াও আহম্মেদ আলী, আফতাব আলী, শেখ নাসির উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের নামে সাত শর বেশি হিসাব খুলে অপরাধলব্ধ আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করতে স্থানান্তর বা রূপান্তর বা হস্তান্তর করে মানি লন্ডারিং অপরাধ সংগঠিত করেছেন বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৫ সালের ২ জুলাই কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ২৪তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি প্রথম সচিব (কর), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঢাকায় কর্মরত আছেন। ফয়সাল মাহমুদ চাকরিতে যোগদান থেকে এ পর্যন্ত অবৈধ ঘুষ লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। তিনি ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হস্তান্তর/রূপান্তর করেন। তিনি ও তাঁর স্বজনদের নামে দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র; ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানে ছয় কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার ৯০৮ টাকা এবং ছয় কোটি ৮৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদসহ মোট ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকা মূল্যের বেশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এই অর্থ অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁদের বৈধ কোনো আয়ের উৎস নেই।
কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড থেকে পাঁচ কাঠার প্লট কিনেছেন। ওই প্লট ক্রয়ে ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা মাহমুদা হাসানের ওয়ান ব্যাংক, ইকুরিয়া শাখার হিসাব থেকে দেওয়া হয়েছে। আদিবা ট্রেডিংয়ের মালিক কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল শাহজালাল ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় থাকা হিসাব থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি চেকের মাধ্যমে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড বরাবর এক কোটি টাকা ইস্যু করা হয়। ওই টাকা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের হিসাব থেকে গেলেও সম্পদ অর্জন করেছেন শ্বশুরের নামে।
কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল নিজ নামে ও তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে জলসিঁড়ি আবাসন প্রকল্পে মোট দুই কোটি ৩৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে পাঁচ কাঠার প্লট কেনেন। প্লটের সীমানা চিহ্নিতকরণ খরচ ও নিরাপত্তা ফি বাবদ অর্থ জমা করতে জলসিঁড়ি আবাসন বরাবর ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল জনৈক খন্দকার হাফিজুর রহমানের ওয়ান ব্যাংকের হিসাব থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি তিনি এই প্লট কেনেন।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী/হাসনা